সরকারি স্কুলগুলিতে কমছে পড়ুয়ার সংখ্যা। কিন্তু কলকাতা শহরে এমন কিছু সরকারি স্কুল রয়েছে, যেখানে পড়ুয়ার সংখ্যা হাজারের বেশি। কোথাও আবার দেড় হাজার ছাড়িয়েছে। ওই সব স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজের জন্য বুথ লেভেল অফিসার (বিএলও) হিসাবে ১০ থেকে ১২ জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীকে নিযুক্ত করা হয়েছে। যার ফলে পঠনপাঠন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ওই শিক্ষকদের মতে, এমনিতেই স্কুলগুলিতে শিক্ষকের সংখ্যা অপ্রতুল। পড়ুয়ার সংখ্যা তুলনায় বেশি। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষকেরা যদি বিএলও হিসাবে অন্য কাজে চলে যান, তা হলে ক্লাস কারা নেবেন?
তার উপরে অগস্ট থেকেই দ্বিতীয় পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। সেই খাতা দেখতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিকের তৃতীয় সিমেস্টারের পরীক্ষাও সামনেই। এই পরিস্থিতিতে স্কুলে শিক্ষকের অভাবে ক্লাস না হলে পড়ুয়াদের পাঠ্যক্রমই শেষ হবে না।
দক্ষিণ কলকাতার যোধপুর পার্ক বয়েজ় স্কুলের প্রধান শিক্ষক অমিত সেন মজুমদার জানাচ্ছেন, তাঁদের স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ১৩৭৭। ওই স্কুল থেকে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী মিলিয়ে ১১ জনকে বিএলও হিসাবে নেওয়া হয়েছে। অমিত বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন বলছে, স্কুলের সময়ের বাইরে এই কাজ করতে হবে। কিন্তু এক জন শিক্ষককে তো স্কুলের সময়ের বাইরেও স্কুল সংক্রান্ত অনেক কাজ করতে হয়। যেমন, দ্বিতীয় পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়নের খাতা দেখা। পড়ুয়াদের নানা ধরনের অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার কাজও স্কুলের সময়ের বাইরেই করতে হয়। স্কুলের পোর্টালের কাজও বাড়ি গিয়ে করতে হয়। এখন শিক্ষকেরা যদি স্কুলের সময়ের বাইরে বিএলও-র কাজে ব্যস্ত থাকেন, তা হলে এই কাজগুলি কারা করবেন?’’ অমিত জানান, তাঁদের দু’জন স্থায়ী গ্রুপ-সি কর্মীকেও এই কাজে নেওয়া হয়েছে। ‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে পড়ুয়াদের ট্যাব দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেই কাজ করেন গ্রুপ-সি কর্মীরা। তাঁরা না থাকলে ট্যাব দেওয়ার কাজই বা হবে কী করে?
বেলতলা গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা অজন্তা মুখোপাধ্যায় জানালেন, অতীতে তাঁরা দেখেছেন, স্কুলের সময়ের মধ্যেই বিএলও-র কাজে চলে যেতে হয়েছে। অজন্তা বলেন, ‘‘আমাদের স্কুলে ১৩৪০ জনের মতো পড়ুয়া রয়েছে। বিএলও হিসাবে ১১ জন শিক্ষিকাকে নেওয়া হয়েছে। তাঁদের ওই কাজ কবে শেষ হবে, তা কেউ জানেন না। ক্লাসের প্রচুর ক্ষতি হবে। পড়ুয়াদের অনেকেরই গৃহশিক্ষক রাখার মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই। অভিভাবকেরা তা হলে কিসের ভরসায় বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাবেন? সরকারি স্কুলগুলিকে কি শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে?’’
মিত্র ইনস্টিটিউশনের (ভবানীপুর) প্রধান শিক্ষক রাজা দে জানালেন, তাঁদের স্কুলে ১১০০ মতো পড়ুয়া রয়েছে। ১২ জন শিক্ষককে ডাকা হয়েছে বিএলও-র কাজের জন্য। রাজা বলেন, ‘‘আমাদের স্কুলে এমন শিক্ষকও রয়েছেন, যিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের একমাত্র শিক্ষক। তা হলে কি ওই বিষয়ের ক্লাস বন্ধ থাকবে? উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পড়ুয়ারা খুব সমস্যায় পড়বে।’’
কমলা গার্লস স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা মিঠু বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা বারোশোর বেশি। অন্তত তাঁদের ১৪ জন শিক্ষিকাকে এই কাজে নেওয়া হয়েছে। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কী ভাবে স্কুল চলবে, জানি না। ক্লাসে শিক্ষিকা না থাকলে সেই সময়ে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে গেলে, তার দায় কে নেবে?’’ যাদবপুর বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক পার্থপ্রতিম বৈদ্য বললেন, ‘‘আমাদের স্কুলে ১৬৫০ জন পড়ুয়া। ১২ জন শিক্ষকের ডাক পড়েছে বিএলও-র কাজের জন্য। উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যক্রম শেষই হবে না।’’
যদিও নির্বাচন কমিশন সূত্রের বক্তব্য, শুধু শিক্ষক-শিক্ষিকারা নন, সরকারি স্থায়ী কর্মচারীদের অনেককেই নিয়োগ করা হচ্ছে। সেটা করছেন ইলেক্টোরাল রেজিস্ট্রেশন অফিসারেরা (ইআরও), যাঁরা এসডিও বা তেমন পদমর্যাদার। তাঁদের বলা হয়েছে স্থায়ী কর্মীদের নিয়োগ করতে। শিক্ষক-শিক্ষিকা বা আর কাদের নিয়োগ করা হবে, সেটা ইআরও-রাই ঠিক করছেন। কমিশনের আরও যুক্তি, প্রশিক্ষণ এক দিনের। সেখানে একসঙ্গে সকলকে যেতে হয় না। তা ছাড়া, শনি এবং রবিবারও বিএলও-র কাজের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ফলে, তাঁরা নিজেদের নির্দিষ্ট কাজের পরেও কমিশনের কাজ করতে পারবেন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)