E-Paper

হাঁটতে বেরিয়ে স্মৃতিবিভ্রম, পথে পথে ঘুরে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু অভুক্ত বৃদ্ধের

সুধীরের পরিবার সূত্রের খবর, গড়িয়ায় তাঁর একটি জুতোর দোকান রয়েছে। বছর চার-পাঁচ আগে স্ট্রোক হওয়ার পরে কথা বলারক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন তিনি। বেশ কয়েক বছর ধরে ডিমেনশিয়ার চিকিৎসাও চলছিল।

মিলন হালদার

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:৩০

—প্রতীকী চিত্র।

হাসপাতালে ভর্তি নিখোঁজ বাবা। আর সেই হাসপাতালেরই মর্গে একের পর এক মৃতদেহের ঢাকা সরিয়ে বাবার খোঁজ করে চলেছেন মেয়ে!

গড়িয়া স্টেশন এলাকার বাসিন্দা, ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ৭৬ বছরের সুধীরকুমার সাহা কিছু দিন আগেবাড়ি থেকে হাঁটতে বেরিয়ে পথ ভুলে আর ফিরতে পারেননি। বাবার খোঁজ শুরু করেন মেয়ে শেলি সাহা। সেই খোঁজ থানা-পুলিশ ঘুরে শেষ হয় বিদ্যাসাগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে। সেখানেই বাবার খোঁজ পান মেয়ে। ওই হাসপাতাল থেকে সুধীরকে গড়িয়ার পিয়ারলেস হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সোমবার সেখানেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর।

বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেসের চিকিৎসক বিমানকান্তি রায় বলছেন, ‘‘ডিমেনশিয়ার অন্যতম প্রধান লক্ষণ ভুলে যাওয়া। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কের অন্যান্য সূক্ষ্ম কাজের ক্ষেত্রেও সমস্যা হয়। তাই রাস্তা ভুল করা,ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়ানো— ডিমেনশিয়ার রোগীদের ক্ষেত্রে এ সব ঘটে। এই রোগীদের বাড়িরবাইরে একা ছাড়া যাবে না। সঙ্গে কাউকে থাকতে হবে। কিন্তু সব সময়ে তা সম্ভব হয় না। অনেক সময়ে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তেরা একাই বেরিয়ে যান। তাই একটি কাগজে নাম-ঠিকানা, যোগাযোগের নম্বর লিখে রোগীর হাতে তাগার মতো বেঁধে দেওয়া যায়। জামা-প্যান্টের পকেটেও রাখা যায়। ডিমেনশিয়ার রোগী থাকলে বাড়ির মূল দরজাও বন্ধ রাখা প্রয়োজন।’’

সুধীরের পরিবার সূত্রের খবর, গড়িয়ায় তাঁর একটি জুতোর দোকান রয়েছে। বছর চার-পাঁচ আগে স্ট্রোক হওয়ার পরে কথা বলারক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন তিনি। বেশ কয়েক বছর ধরে ডিমেনশিয়ার চিকিৎসাও চলছিল। গত ৬ নভেম্বর বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিলেনসুধীর। বড় মেয়ে শেলি বলেন, ‘‘বাবার ডিমেনশিয়া ছিল। কিন্তু এমনপর্যায়ের নয় যে, বাবা সব কিছু ভুলে যেতেন। একটি নির্দিষ্ট জায়গাদিয়ে হেঁটে বাড়ি চলে আসতেন। ওই দিন ভুল করে বাড়ির ডান দিকের গলির বদলে বাঁ দিকের গলিতে ঢুকে সোজা পৌঁছে যান বাইপাসে।হেঁটে পাটুলি পেট্রল পাম্প হয়ে বাঘা যতীন মোড় পর্যন্ত চলে যান। বাঘা যতীন রেল সেতুর কাছ থেকে সার্ভিস রোড ধরেন বাবা। বিভিন্নজায়গার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে এ বিষয়ে জানতে পারি। কিন্তু, তার পরে বাবা কোথায় গেলেন, তা জানতে পারিনি।’’

এর পরে সুধীরের বাড়ির লোকজন নরেন্দ্রপুর থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন। সুধীরের ছবি দেখিয়ে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ শুরু করেন তাঁরা। বিষয়টি ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিয়ো ক্লাবকে জানানো হয়। রেডিয়ো ক্লাবও খোঁজ শুরু করে। সমাজমাধ্যমেও বিষয়টি জানানো হয়। এর পরে ১১ নভেম্বর সন্ধ্যায় বেহালার ব্যানার্জিপাড়ার এক মহিলা ফোন করে জানান, ৮ নভেম্বর তাঁদের ফ্ল্যাটের নীচে সুধীর বসে ছিলেন। কিন্তু তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। সমাজমাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরে তিনি ফোন করেন।

এর পরে ওই এলাকায় খোঁজ শুরু হয়। ১১ নভেম্বর রাতে শেলিরপাড়ার ছেলেরা বেহালা, ঠাকুরপুকুর, পর্ণশ্রী থানায় খোঁজ করলেও পুলিশ কিছু জানাতে পারেনি। ১২ নভেম্বর সকাল থেকে বেহালায় বাবার খোঁজ শুরু করেন শেলি। তাঁর কথায়, ‘‘বেহালা থানা থেকে আমাকে বিদ্যাসাগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে খোঁজ করতে বলা হয়। আমি সেখানে গেলে হাসপাতালের তরফে জানানো হয়, তেমন কেউ সেখানে ভর্তি হননি। যাঁদের পাওয়া গিয়েছে, সকলেই মৃত। মর্গে গিয়ে দেখতে বলা হয়। আমি মর্গে গিয়ে বাবার খোঁজ শুরু করি। সেখানেও পাইনি।’’

পরের দিন ফের কয়েক জনকে নিয়ে ওই এলাকায় যান শেলি। তিনি বলেন, ‘‘সে দিন ঠাকুরপুকুর থানায় গেলে এক পুলিশকর্মী বাবার ছবি দেখে জানান, ১১ নভেম্বর রাতে বাবাকে উদ্ধার করে বিদ্যাসাগর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর পরে ওই হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারি, বাবা সেখানেভর্তি আছেন। অবস্থা খুব খারাপ। অচৈতন্য হয়ে রয়েছেন। এক ঘণ্টার মধ্যে বাবাকে অ্যাম্বুল্যান্সে করে গড়িয়ার পিয়ারলেস হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু বাবাকে বাঁচানো গেল না। ডাক্তারেরা জানান, অনেক দিন না খেয়ে থাকায় রক্তচাপ ও অক্সিজেনের মাত্রা মারাত্মক কমে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে রক্তে একটা সংক্রমণও হয়েছিল।’’

শেলি জানান, স্থানীয় থানার পাশাপাশি সুধীরের নিখোঁজ হওয়ার কথা ভবানী ভবন, লালবাজারেও জানানো হয়েছিল। ‘‘কিন্তু পুলিশের আগেই আমরা বাবাকে খুঁজে বার করি। আর খুঁজতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হল, তা ভয়ঙ্কর’’— বলছেন পিতৃহারা কন্যা। প্রশ্ন উঠেছে, এই ঘটনায় পুলিশের সক্রিয়তার কি অভাব ছিল? এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘খোঁজ নিয়ে দেখছি, ঠিক কী ঘটেছিল।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Death Garia

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy