আরোগ্যনিকেতন: মদনগোপাল লেনের চিলতে ঘরে কাজে মগ্ন স্বপন দত্ত। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
একট দূরে সরগরম বইপাড়া, উল্টো দিকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বা কয়েক পা এগিয়ে কুখ্যাত প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট। এ সবের মাঝে অকিঞ্চিৎকর একটি বিন্দু এই গলি। মদনগোপাল লেনের এইটুকু ঘরেই রাজ্যপাট ছিপছিপে ঋজু প্রবীণের। তাঁর পা থেকে মাথা পর্যন্ত আদুরে বেড়ালছানার মতো খেলছে মূর্তিমান সময়ের কোলাজ।
বাইরের কলকাতার আবহসঙ্গীত এ ঘরে ঢোকে না ভাগ্যিস! বদলে স্বপন দত্তের কোলের কাছে ক্ষণে ক্ষণে ১০০ বছরের বিলিতি ঘড়িটার মিঠে চাইমিং! ‘ঘড়ির ডাক্তার’ স্বপনবাবু এ সুরে শিশুর মতো খুশি হন। ‘‘শুনলেন, শুনলেন এ হল কোয়ার্টার চাইমিং ক্লক। ১৫ মিনিট অন্তর বেজে ওঠে।’’ এ ঘড়ির তিনটে চাবি আর আটটা বেল। ১৫ মিনিট অন্তর ৮ বার, ১৬ বার, ২৪ বার, ৩২ বার বেজে ওঠার পরে, ঠিক যত বাজবে তত বার মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনির মতো মন্দ্রস্বরে কথা বলবে ঘড়িটি। এ ঘড়ির সংলাপের রেশ না-কাটতেই স্বপনবাবুর পায়ের কাছে বেজে ওঠে আর একটি সুদৃশ্য দেওয়াল ঘড়ি। তার বয়সও নেহাত কম নয়।
প্রথম ঘড়িটি না কি কলকাতার বিখ্যাত সাগর দত্তদের পরিবারের। বার্ধক্যজনিত অসুখ সারাতে ফিয়ার্স লেনের বাড়ি থেকে স্বপনবাবুর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আর একটি ঘড়ি শরৎ বসু রোডের বনেদি ঘর সাধু পরিবারের। চিলতে ঘরটাই ‘ঘড়ির হাসপাতাল’। ডাক্তারবাবু স্বপন দত্তের নজরবন্দি নানা কিসিমের বুড়ো ঘড়ির ভিড়। খান দুয়েক প্রাচীন ঘড়ি আবার হাইকোর্টের সিনিয়র বার লাইব্রেরির। সব থেকে রূপসী, ঘরের দরজার পাশের দেওয়ালে কাঠের কারুকাজ করা সুইস ঘড়িটি। এ শহরের কোনও পরিচিত পার্সি প্রবীণের সূত্রে মুম্বই থেকে রোগ সারাতে কলকাতায় এসেছে। স্বপনবাবু চেনান, কাক্কু ক্লক! দেখতে দেখতেই সন্ধে ছ’টা বাজল! অমনি দরজা খুলে মিষ্টি পাখি বেরিয়ে আসে, ছ’বার কুহু স্বরে ডেকে ওঠে।
ঘড়ির হাসপাতালে রোগীর আসা-যাওয়া লেগে থাকে! ‘‘খুব ধৈর্যের কাজ বুঝলেন! ঘড়ির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খুঁটিয়ে দেখে গোটা শরীরটা মুখস্থ করে ফেলতে হয়।’’ ডাক্তারের চোখের গুণেই ধরা পড়ে অসুখ! তারপর ক’দিন নজরদারির জন্য হাসপাতালে বিশ্রামে থাকে ঘড়িটি।
৭০ পার করা স্বপনবাবুর আউটডোর ডিউটিও থাকে ফি-সকালে। কলকাতা পুরসভার সব ঘড়ির রক্ষণাবেক্ষণের দায় সাকুল্যে ম্যাট্রিক পাশ এই ডাক্তারবাবুর। গম্বুজ মেরামতি চলছে বলে নিউ মার্কেটের বিখ্যাত ঘড়ি এখন বন্ধ বটে। তবে ধর্মতলার গির্জা বা জোড়া গির্জার ঘড়ি, খিদিরপুর ডকের ঘড়ি, শিবপুর বিই কলেজ বা বর্ধমানের কাছারি বাড়ির ঘড়িকে ওযুধ দিতে যেতে হয় ঘন ঘন। তিন মাস অন্তর হরিদ্বারে হর কি পৌরির ঘাটের বিখ্যাত ‘টাওয়ার ক্লক’ সারাতেও কলকাতার ঘড়ির ডাক্তার মুশকিল আসান। গোয়ার ভাস্কোর পুরনো বাজারের ঘড়ি, পঞ্জাবের কপূরথালার ‘হেরিটেজ ঘড়ি’ স্বপনবাবুই সারিয়েছেন। বিমানের ইঞ্জিনিয়ারেরা ফেল মারলেও তিনি অপরাজেয়। ১৯৮৯-এ স্বপনবাবুর পরামর্শেই বসল ব্যান্ডেল চার্চের নতুন ঘড়ি। গির্জার ইতালিয়ান ফাদার নিয়মিত আসতেন কলেজ স্ট্রিটের ডেরায়।
ঘড়ির ডাক্তারবাবু একদা অনেক দেখা যেত কলকাতায়। এখন সব ‘ভ্যানিশ’। স্বপনবাবুর পাঁচ পুরুষের ঘড়ি সারাইয়ের কারবারে বড় ছেলে সত্যজিৎও সামিল হয়েছেন। বাপ-ছেলে মিলে এখনও বরাত মাফিক গম্বুজ ঘড়ি তৈরি করেন। লেক টাউনের বিগ বেনের ভিতরের যন্ত্র, কাঁটা স্বপনবাবুই সরবরাহ করেছেন। কিন্তু তাঁর মতে, সাবেক বিলিতি ঘড়ির মতো সৃষ্টি এ কালে দুর্লভ।
হাতে হাতে স্মার্টফোনধারী জেট যুগে শৌখিন দেওয়াল ঘড়ির সমঝদারই বা ক’জন! তবে কালের চিরচঞ্চল গতি বন্দি ঘড়িবাবুর হাসপাতালে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy