Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Fact Check

আমপানের তাণ্ডবের সন্ধ্যায় জল ভরেই বাঁচানো হয়েছিল টালা ট্যাঙ্ক! সত্যি না মিথ্যে?

উম্ফুনের ক্ষমতা হয়নি সেই ওজনদার কাঠামোকে নড়াবার। বিদ্যুৎ সংযোগ চলে আসার পর টালার ট্যাঙ্ক যথারীতি কলকাতা জুড়ে তার সরবরাহ বজায় রাখে। ট্যাঙ্ক ভেঙে পড়লে কী হত তা সহজেই অনুমেয়।

এই পোস্টটই ভাইরাল হয়েছে।

এই পোস্টটই ভাইরাল হয়েছে।

ঋত্বিক দাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০২০ ১৬:৪৯
Share: Save:

কী ছড়িয়েছে?

একটি ছবি, সঙ্গে লেখা— “এই ভদ্রলোককে কলকাতাবাসী চিনুন। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রাক্তনী বর্তমানে ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার অমিতাভ পাল, KMC শ্রী অমিতাভ পাল। ... যেদিন উম্ফুন আসে পরিস্থিতি অনুধাবন করে উনি বিকেলে টালার ট্যাঙ্কে পৌঁছন। ১০০ বছরের পুরনো কাঠের কাঠামোর উপর দাড়ানো লোহার ট্যাঙ্ক যা টাইটানিকের সমমানের স্টিল দিয়ে তৈরি এই মুহূর্তে সংস্কারের প্রসেসে আছে। সুনিপুণ স্থাপত্যবিদ অমিতাভবাবু সেই মুহূর্তে নির্দেশ দেন জলাধারটিকে সম্পুর্ণ ভরে ফেলার। ট্যাঙ্কের ৪টি ইউনিট ৮৫ হাজার মেঃটন জল ভরে জল সাপ্লাই বন্ধ করে দেওয়ার আদেশ দেন অমিতাভবাবু।

উম্ফুনের ক্ষমতা হয়নি সেই ওজনদার কাঠামোকে নড়াবার। বিদ্যুৎ সংযোগ চলে আসার পর টালার ট্যাঙ্ক যথারীতি কলকাতা জুড়ে তার সরবরাহ বজায় রাখে। ট্যাঙ্ক ভেঙে পড়লে কী হত তা সহজেই অনুমেয়।

আপনাকে কুর্নিশ জানাই অমিতাভবাবু।

পুনশ্চ: শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী উনি ২০ তারিখ থেকে এখনও অবধি বাড়ি যাননি।’’

কোথায় ছড়িয়েছে?

ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে এই পোস্ট। শেয়ার হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপেও। এই প্রতিবেদন লেখার সময় আসল পোস্টটি ১১ হাজার বার শেয়ার হয়েছে।


ভাইরাল হওয়া সেই পোস্ট

এই তথ্য কি সঠিক?

না এই তথ্য ঠিক নয়। ওই পোস্টে যাঁর ছবি শেয়ার করা হয়েছে, তিনি অমিতাভ পাল, কলকাতা পুরসভার জল সরবরাহ বিভাগের ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার। বর্তমানে ওই বিভাগের কার্যনির্বাহী ডিজি হিসেবে কাজ করছেন। আমপানের দিনে বিকেলে তিনি টালা পাম্পিং স্টেশন বা টালা ট্যাঙ্ক চত্বরে উপস্থিতই ছিলেন না। ঝড়ের সময় টালা ট্যাঙ্কে অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি জল রাখা হলেও, তা পুরোপুরি ভর্তি করে রাখা হয়নি। টালা ট্যাঙ্ক ভর্তি রাখা সিদ্ধান্তটাও দুর্যোগের সেই দিনে নেওয়া কোনও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নয়।

ফেসবুকের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট ও পেজে শেয়ার হয়েছে এই পোস্ট

সত্যি কী এবং আনন্দবাজার কী ভাবে তা যাচাই করল?

ভাইরাল হওয়া পোস্টটি শেয়ার হয় ২৫ মে রাত্রি ন’টা নাগাদ। পোস্টটিতে বলা হয়, ‘শেষ পাওয়া খবর অনুয়ায়ী ২০ মে থেকে অমিতাভ বাবু টানা ডিউটিতেই রয়েছেন’। অমিতাভ পাল নিজে এই দাবি উড়িয়েছেন। আনন্দবাজার ডিজিটালের তরফে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে হলে হল তিনি বলেন, “টালা ট্যাঙ্কে আমি রোজই যাই, সে দিন সকালেও গেছিলাম। কিন্তু ওই দিন রাতে কলকাতা পুরসভার সদর দফতরে আমার অফিসে ছিলাম, পরের দিন বাড়ি ফিরেছি”।

আমপান দুর্যোগ কী ভাবে কাটাল টালা ট্যাঙ্ক, ঠিক কী ঘটেছিল সে দিন?

টালা পাম্পিং স্টেশনের দায়িত্বে রয়েছেন কলকাতা পুরসভার এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার অম্লান ধর। বিগত ষোলো বছর ধরে শতায়ূ এই ট্যাঙ্কের সঙ্গেই যাঁর ওঠাবসা। তাঁর কথায়, ‘‘ওই সন্ধেটা খুব কঠিন সময় ছিল, ঈশ্বর বাঁচিয়েছেন।’’ দুর্যোগের দিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ২১ তারিখ সন্ধে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত তিনি সেখানেই উপস্থিত ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন পুরসভার আরও ৮ জন ইঞ্জিনিয়ার। আর কলকাতা পুরসভার সদর দফতর থেকে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন অমিতাভবাবু আনন্দবাজারকে তিনি বলেন, “এত বড় ট্যাঙ্ক, একটা ভয় তো ছিলই। এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয় সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের কারওরই ছিল না। কিন্ত বেসিক ইঞ্জিনিয়ারিং আমরা সকলেই শিখেছি। আমি নিজে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। সবাই মিলেই একটা সিদ্ধান্ত নিলাম”।

টালা ট্যাঙ্ক ছাড়াও টালায় রয়েছে ৪টি ভূগর্ভস্থ জলাধার। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এগুলো ফাঁকা হতে থাকে এবং প্রতিদিন সন্ধে ৬টা নাগাদ এগুলোর জল প্রায় তলানিতে পৌঁছে যায়। ফলে চাপ পড়ে টালা ট্যাঙ্কে। যেটি ব্যালান্সিং রিজার্ভার হিসেবে কাজ করে এবং এর জলও হু হু করে কমতে থাকে। এই অবস্থায় সুপার সাইক্লোন আমপান ধেয়ে আসলে, সেই ঝড়ের চাপে ট্যাঙ্কের ক্ষতি হতে পারে বলে শঙ্কা ছিল। তাই কী ভাবে মোকাবিলা করা যায়, প্ল্যান করা হচ্ছিল আগে থেকেই। কথা বলা হয়েছিল টালা ট্যাঙ্কের রক্ষণাবেক্ষণে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, শিবপুর আইআইইএসটি এবং আইআইটি খড়্গপুরের পরামর্শদাতাদের সঙ্গেও।

অম্লানবাবু জানান, ‘‘আগের দিনই আমাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল। অন্যান্য দিনের থেকে অন্তত তিন-চার ফুট বেশি রাখার চেষ্টায় ছিলাম আমরা। কারণ ট্যাঙ্কে জল যত বেশি রাখতে পারব, ততই হাওয়ার ডিফারেনশিয়াল প্রেশারে তার ক্ষতি হওয়া সম্ভাবনা কম হবে। সে দিন আমরা চেষ্টা করেছিলাম যাতে ট্যাঙ্ক অন্তত ৫০ শতাংশ ভর্তি থাকে।’’

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

১৬ ফুট গভীর টালা ট্যাঙ্কে ৪৪ মিলিয়ন গ্যালন জল ধরে। এর মধ্যে ৫-৬ মিলিয়ন বাফার। ২০ মে বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ ট্যাঙ্কটিতে ১৩ ফুট জল ভরা হয়। সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনেটে টালায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। অন্যান্য দিন এই সময় ট্যাঙ্কে প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ ফুট জল থাকলেও সে দিন ৭ ফুট ৯ ইঞ্চি জল ছিল। অর্থাৎ পরিকল্পনা মাফিক ট্যাঙ্কের গভীরতার প্রায় ৫০ শতাংশ। ঝড়ের সময় ট্যাঙ্কের জল যাতে না কম যায়, তাই কমিয়ে দেওয়া হয় কাশীপুর অঞ্চলের জল সরবরাহ। রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ যখন টালায় ফের বিদ্যুৎ সংযোগ আসে, তখন ওয়াটার লেভেল ইন্ডিকেটরে দেখা যায়, জলস্তর খুব একটা কমেনি। তত ক্ষণে ঝড়ও কেটে গিয়েছে।

কারও একক কৃতিত্বে নয়, দলগত ভাবে কাজ করেই ২০ মে আমপান তাণ্ডব থেকে রক্ষা পেয়েছে শতাব্দী প্রাচীন টালা ট্যাঙ্ক।

হোয়াটস‌্অ্যাপ, ফেসবুক, টুইটারে যা-ই দেখবেন, তা-ই বিশ্বাস করবেন না। শেয়ারও করে দেবেন না। বিশেষত এই আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় তো তো নয়ই। এ ভাবেই ছড়িয়ে পড়ে ভুয়ো খবর। যাচাই করুন। কোনও খবর, তথ্য, ছবি বা ভিডিয়ো নিয়ে মনে সংশয় দেখা দিলে আমাদের জানান এই ঠিকানায় feedback@abpdigital.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE