Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কালীপুজোর শব্দ-জব্দ উড়িয়ে দিল দিওয়ালি

আঙুল দিয়ে ঘন ঘন দু’কান চাপা দিতে হয়। কালীপুজোর সন্ধ্যায় বাইরে বেরোলে বরাবর এমনটাই করে এসেছেন শম্ভু ভট্টাচার্য। তবে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বেরিয়ে তেমন উপদ্রব পোহাতে হয়নি বলেই জানাচ্ছেন সত্তরোর্ধ্ব ওই ব্যক্তি। যাদবপুরের বাসিন্দা শম্ভুবাবু বরং খানিকটা অবাকই এই অভিজ্ঞতায়।

দীপাবলির রোশনাই। সল্টলেকের বিএফ-সিএফ পার্কে। ছবি: শৌভিক দে।

দীপাবলির রোশনাই। সল্টলেকের বিএফ-সিএফ পার্কে। ছবি: শৌভিক দে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৩১
Share: Save:

আঙুল দিয়ে ঘন ঘন দু’কান চাপা দিতে হয়। কালীপুজোর সন্ধ্যায় বাইরে বেরোলে বরাবর এমনটাই করে এসেছেন শম্ভু ভট্টাচার্য। তবে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বেরিয়ে তেমন উপদ্রব পোহাতে হয়নি বলেই জানাচ্ছেন সত্তরোর্ধ্ব ওই ব্যক্তি। যাদবপুরের বাসিন্দা শম্ভুবাবু বরং খানিকটা অবাকই এই অভিজ্ঞতায়।

কালীপুজোর রাতে শব্দবাজিতে রীতিমতো লাগাম টেনেছিল পুলিশ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। কিন্তু বুধবার, ‘দিওয়ালি’র সন্ধ্যা পেরোতেই শহর জুড়ে ছবিটা অনেকটা বদলে গেল। প্রায় সর্বত্রই দাপিয়ে বেড়াল শব্দদানব। রাতে পাইকপাড়া, আলিপুর, চেতলা, ভবানীপুর, মধ্য কলকাতা, সল্টলেক, উত্তর ও দক্ষিণ শহরতলির বিভিন্ন এলাকায় দেদার শব্দবাজি ফাটানোর অভিযোগ মিলেছে। শব্দবাজি ফেটেছে বিভিন্ন হাসপাতাল লাগোয়া এলাকাতেও। তবে অনেকে এ-ও বলছেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বার দীপাবলির রাতে শব্দের দাপট তুলনায় কিছুটা কম মালুম হয়েছে।

রাস্তায় নেমে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নড়াচড়া এ বছর তেমন চোখে পড়েনি। কিন্তু জাতীয় পরিবেশ আদালতের পরপর দু’টি নির্দেশ ও তার জেরে অন্য বারের তুলনায় পুলিশের তল্লাশি ও ধরপাকড় যে বেশি ছিল, সেটা মেনে নিচ্ছেন বাজি উৎপাদক ও ব্যবসায়ী, এমনকী ক্রেতারাও। মুদিয়ালির বাসিন্দা, পেশায় কলেজশিক্ষিকা মালিনী গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আগে কালীপুজোর সন্ধ্যায় বেরোতেই ভয় করত বাজির জন্য। এ বার কিন্তু পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত।’’ উত্তরপাড়ার পীযূষ আচার্যও বলছেন, ‘‘মনে হচ্ছে, শব্দবাজির ক্ষতি নিয়ে অনেকের মনে ভয় ধরে গিয়েছে। রাত ১২টার মধ্যেই এ বার চতুর্দিক নিঝুম হয়ে গেল।’’

বুধবার সন্ধ্যা থেকেই অবশ্য শব্দবাজি নিয়ে ঘনঘন অভিযোগ গিয়েছে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং পুলিশের কাছে। এমনকী, পর্ষদের কন্ট্রোল রুমে ফোন করলে সমস্ত নম্বর ব্যস্ত বলে শোনা গিয়েছে বারবারই। মঙ্গল ও বুধবার, দু’দিনই শহরে শব্দবাজি নিয়ে নজরদারিতে বেরিয়েছিলেন পরিবেশ নিয়ে কাজ করা কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সবুজ মঞ্চের প্রতিনিধিরা। তাদের তরফে নব দত্ত বলেন, ‘‘মঙ্গলবার পুলিশের একাংশ সক্রিয় থাকায় শব্দবাজির দাপট তুলনায় কিছুটা কম ছিল। কিন্তু বুধবার পুলিশ-প্রশাসনের সক্রিয়তা চোখে পড়েনি।’’

দীর্ঘ টালবাহানা, আইনি বিতর্কের পরে কালীপুজোর মাত্র সপ্তাহখানেক আগে, ২ নভেম্বর রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ জানায়, পশ্চিমবঙ্গে বাজির শব্দমাত্রা ৯০ ডেসিবেল (এর চেয়ে কম শব্দমাত্রায় খেলনা পিস্তলে ফাটানোর ক্যাপ ছাড়া অন্য শব্দবাজি তৈরি কার্যত অসম্ভব)। পর্ষদ কার্যত চুপচাপ থাকলেও সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে শব্দবাজি ব্যবহার থেকে দূরে থাকার জোরদার প্রচার শুরু করে পুলিশ। মাইকেও প্রচার চলে। পরে পরিবেশ আদালতও পর্ষদের নির্দেশ বহাল রাখায় শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়। সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান বাবলা রায়ের কথায়, ‘‘২ নভেম্বর পর্ষদ বিজ্ঞপ্তি জারির সঙ্গে সঙ্গে পুলিশও শব্দবাজির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।’’

মঙ্গলবার চম্পাহাটি থেকে দু’ব্যাগ বাজি কিনে ফিরছিলেন টালিগঞ্জের রেখা দে। তিনি বলেন, ‘‘দু’জায়গায় পুলিশ অটো থামিয়ে বাজির ব্যাগ পরীক্ষা করল। এমন কিন্তু আগে দেখিনি।’’ চারু মার্কেটের দুই যুবক, প্রদীপ মল্লিক ও কাঞ্চন বসাকও বললেন, ‘‘১০০ পিস চকোলেট ব্যাগের নীচে ছিল। উপরে ছিল আলোর বাজি। পুলিশ উপুড় করে সব ঢেলে দেখল। ধরা পড়ে গেলাম।’’

কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্রের মতে, মানুষের সচেতনতাও বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘‘বড় রাস্তার পাশাপাশি এ বার গলি, তস্য গলিতেও নজর রেখেছি, যাতে নিষিদ্ধ বাজি না পোড়ানো হয়।’’ বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ মঙ্গলবার রাতেও সল্টলেক থেকে ১৫০ কেজি শব্দবাজি আটক করে। লালবাজারের সূত্রের খবর, মোটরবাইক, অটোয় টহলদারি চলেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন বহুতলের সঙ্গে কথা বলে শব্দবাজি ফাটাতে নিষেধ করেছিল পুলিশ। সল্টলেকে গত কয়েক বছরের তুলনায় শব্দের দাপট অনেকটা কম বলেই দাবি পুলিশের একাংশের। শব্দবাজি রুখতে বিধাননগরের আবাসনের বাসিন্দাদের কাছে ডুপ্লিকেট চাবি চেয়ে পুলিশি আবেদনে তেমন সাড়া না মিললেও এলাকাবাসীর একাংশ বুঝছেন, শব্দবাজি ঠেকাতে পুলিশ অন্তত চেষ্টা করছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্রের কথায়, ‘‘প্রশাসন ও সংবাদমাধ্যমের লাগাতার প্রচারের ফলে প্রতি ১০ জনে ৯ জনই এখন শব্দবাজির বিরোধী। ফলে, তার দাপট কমছে।’’

অনেকে বলছেন, মঙ্গলবারও শহরের বেশ কিছু এলাকায় শব্দবাজির দাপট ছিল। দক্ষিণ শহরতলির নাকতলা, দক্ষিণ কলকাতার যোধপুর পার্ক ও প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড, উত্তর কলকাতার সিঁথি, উত্তর শহরতলির দমদম, বাগুইআটিতে দেদার ফেটেছে শব্দবাজি এবং পুলিশেরও দেখা মেলেনি। অভিযোগ, বিশেষত শহরতলির বড় অংশে রাত সাড়ে ন’টার পর থেকে তুমুল দাপট ছিল শব্দদৈত্যের। পুলিশের অস্তিত্বই চোখে পড়েনি। একই অবস্থা ছিল বেলেঘাটা ও সল্টলেকের কিছু তল্লাটে। পর্ষদের নজরদারি দলের দেখা মেলেনি। কন্ট্রোল রুমে মাঝরাতে ফোন করে সাড়া মেলেনি, এমন অভিযোগও এসেছে।

পর্ষদ এবং পুলিশের একাংশ মেনে নিচ্ছেন, কালীপুজোর রাতে শহরের বিভিন্ন তল্লাটে শব্দবাজি ফেটেছিল। বুধবার তা অনেক বড় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। লালবাজারের এক কর্তার কথায়, ‘‘আমরা তো শব্দবাজি ফাটাতে না করেছিলাম। কিন্তু কেউ কেউ সেই অনুরোধ রাখেননি।’’

তাঁর ব্যাখ্যা, এক বারে এই দাপট কমানো সম্ভব নয়। তবে শব্দবাজি ফাটানোর অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ ধরপাকড় করলে এই শব্দবাজি লোকে পেল কী করে? বাজি ব্যবসায়ী এবং পুলিশ বলছে, শব্দমাত্রা নিয়ে বিভ্রান্তির ফাঁকে অন্তত ২০০ টন শব্দবাজি ক্রেতাদের হাতে চলে গিয়েছিল। বিশেষ করে যাঁরা দীপাবলিতে শব্দবাজি ফাটানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন, তাঁরা আগেভাগেই কিনে রেখেছিলেন। তাঁরাই এ দিন সন্ধ্যার পর থেকে আওয়াজে এলাকা কাঁপিয়েছেন। এবং এর ফলেই আলোর উৎসবে ‘পাশ’ করলেও ‘লেটার মার্কস’ পাওয়া হল না পুলিশ-পর্ষদের। এই প্রসঙ্গে বুধবার রাজ্যের পরিবেশকর্মী ও পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘শুধু পরীক্ষার দিন কয়েক আগে পড়াশোনা করে লেটার মার্কস পাওয়া অসম্ভব। পাশ করলেই অনেক।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kali puja kolkata noise pollution firecrackers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE