E-Paper

বছর শেষের উৎসবেও কিছু লড়াই কখনও বদলায় না 

বছরের শেষ দিন বলে নিজেকে ছাড় দেওয়ার মেজাজে দেখা দিলেন বেশির ভাগই। সেই সঙ্গে নতুন শুরুকে সামনে রেখে নিজের জীবনেও কিছু একটা নতুন করার অঙ্গীকার করলেন অনেকেই।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৪ ০৫:১১
An image of Balloons

বৈপরীত্য: বর্ষশেষের রাতে আলো ঝলমলে পার্ক স্ট্রিটে বাড়ছে উৎসাহীদের ভিড়। সেখানেই রোজগারের আশায় বেলুন হাতে অপেক্ষায় দুই কিশোরী। রবিবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

‘‘বছরের শেষ দিন তো, আইসক্রিম খেতেই পারি। সুগারের ব্যাপারে কাল থেকে সতর্ক হব। এ বছর নিয়ম করে মিষ্টি খাওয়া কমাব!’’

‘‘আজ অন্তত খরচ নিয়ে ভাবছিই না। ভাল কোথাও রাতের খাবার খাব। ঠিক করেছি, নতুন বছরে বুঝে খরচ করব। টাকা জমাতেই হবে!’’

‘‘দেরি করে ফিরলেও কিছু না। এটাই তো বছরের শেষ রাত। নতুন বছরে সময় মতো সব কাজ করব।’’

রবিবার, শহরের পথে বর্ষশেষের উৎসবে ভেসে এল এমন টুকরো টুকরো কথা। বছরের শেষ দিন বলে নিজেকে ছাড় দেওয়ার মেজাজে দেখা দিলেন বেশির ভাগই। সেই সঙ্গে নতুন শুরুকে সামনে রেখে নিজের জীবনেও কিছু একটা নতুন করার অঙ্গীকার করলেন অনেকেই। কিন্তু চাইলেই কি নিজের ইচ্ছে মতো বছরের শেষ দিনটা কাটানোর অধিকার সকলের থাকে?

এ দিন স্বাভাবিক ভাবেই উপচে পড়া ভিড় ছিল চিড়িয়াখানা, ইকো পার্ক, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, জাদুঘর, মিলেনিয়াম পার্ক, প্রিন্সেপ ঘাট, ময়দানে। গত বৃহস্পতিবার থেকে বাড়তে থাকা সর্বনিম্ন তাপমাত্রা আজ কিছুটা কমায় সেই উৎসবের মেজাজ আরও জমে গিয়েছে। আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, এ দিন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৬.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্বাভাবিকের চেয়ে তা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হলেও গত কয়েক দিনের চেয়ে তা কম। অর্থাৎ, কিছুটা ঠান্ডা অনুভূত হয়েছে সকাল থেকেই। তার মধ্যেই ইকো পার্কে এ দিন ভিড় হয়েছিল প্রায় ৫৭ হাজার উৎসাহী জনতার। চিড়িয়াখানায় উপস্থিতির সংখ্যা ছিল ৭১ হাজারের কিছু বেশি। তবে জাদুঘরে ন’হাজার এবং কলকাতার নতুন জেল মিউজিয়ামে লোক হয়েছে প্রায় আট হাজার।

ইকো পার্কে দেখা গেল, ঝুরিভাজার ডালা কাঁধে ঝুলিয়ে খালি পায়ে ছুটছেন এক ব্যক্তি। নাম জিজ্ঞেস করতে কোনও রকমে উত্তর দিলেন সুশান্ত দাস। চাঁদপাড়ায় তাঁর বাড়ি। ভোরে বেরিয়ে ইকো পার্কে এসেছেন ভাল বিক্রির আশায়। কিন্তু খালি পায়ে ছুটছেন কেন? হাসি হাসি মুখে যুবকের উত্তর, ‘‘সকালে ঢুকেই জুতো খুলে এক জায়গায় গাছের পিছনে লুকিয়ে রেখে দিয়েছি। যাতে তাড়া খেলে ছুটতে সুবিধা হয়! এক বার ধরে ফেললে তো আর ডালা ছাড়বে না। সব মাটি!’’ তাড়া করবে কেন? তাঁর উত্তর, ‘‘লোকে ভিড় করে কেনেন আমাদের থেকে। কিন্তু এখানে ভিড় করতে দেওয়া হয় না। তাই আমাদের দেখলেই তাড়ানো হয়। আমাদের তো বিক্রিবাটা ভাল হলেই আনন্দ হয়।’’ এর পরে পরিচিত এক পুলিশকর্মী দূর থেকে নাম ধরে ডাকলেন সুশান্তকে। তাঁকেও যেন বিশ্বাস নেই যুবকের। কথা শেষ না করেই বলে উঠলেন, ‘‘গেলেই তো ধরবেন। পরে আসছি।’’ বলে ছুটতে শুরু করলেন ।

ইকো পার্কের বাইরেই আবার দেখা গেল, বছর সাতেকের এক বালক তার দ্বিগুণ উচ্চতার স্ট্যান্ডে প্যাকেট ভর্তি ‘বুড়ির চুল’ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চোখেমুখে ক্লান্তি স্পষ্ট। কাছে গিয়ে কথা বলতেই দেখিয়ে দিল কিছুটা দূরে দোকানে বসা দিদিমাকে। সৈয়ম আলি মণ্ডল নামে ওই বালক বলে, ‘‘বাবা পাঁচিল গাঁথার কাজে যায়। মা রান্না করছে। আমি তাই দোকান দিয়েছি।’’ কোথাও ঘুরতে যাবে না? প্রশ্নের উত্তরে ফ্যালফ্যাল করে শুধুই তাকিয়ে থাকে সে। দিদিমা কাছে এসে বললেন, ‘‘কাছেই বাড়ি আমাদের। কাজ না করলে খাওয়া হবে কোথা থেকে? বাচ্চা হলে কী হবে, ও বোঝে সব। তাই বায়না করে না।’’

চিড়িয়াখানায় দেখা গেল, বেলুন কিনে দেওয়ার বায়না করা মেয়েকে তার মা বোঝাচ্ছেন, ‘‘হাওয়া শেষ হলেই তো শেষ। তার চেয়ে চল পেস্ট্রি কিনে দিচ্ছি!’’ ছোট্ট মেয়ের আনন্দ দেখে মনে হল প্রস্তাবটা মনে ধরেছে। ভিড়ের পার্ক স্ট্রিট আবার অন্য চেহারায়। সেখানে বাচ্চা কোলে টুপির দোকান সামলানো মা বলে উঠলেন, ‘‘আর অন্তত দশটা টুপি বিক্রি হয়ে গেলেই উঠে যাব। কাল বাচ্চা নিয়ে হাসনাবাদের ট্রেন ধরে বাড়ি যেতে পারব। বাচ্চাটাকে দেখে অনেকে এমনিই টাকা দিতে চাইছিলেন। আমি বলেছি টুপি কিনুন, এমনি টাকা নেব না।’’ পাশের রেস্তরাঁর ভিড় তখন টুপির স্টলের সামনে উঠে আসছে প্রায়।

দিনভর মাথায় ঘুরতে থাকা কথাটা আবারও মনে পড়ল। বছরের শেষ দিন হলেই বা, চাইলেই অন্য রকম করে কাটানোর অধিকার সকলের থাকে না। কিছু লড়াই বছর শেষেও বদলায় না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

new year eve New Year 2024 Kolkata Street hawkers

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy