কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যশালী কমলা বক্তৃতামালায় ১৯৬৫ সালের শেষে পর পর কয়েকটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলমান সংস্কৃতি, হিন্দু সংস্কৃতি এবং হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয় বিষয়ে বাংলায় তিনটি বক্তৃতা দেন তিনি। এর পরে পটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে তাঁর চতুর্থ বক্তৃতাটি ছিল ‘কালচার ইন মিডিয়েভাল বেঙ্গল’!
আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অকালপ্রয়াত কন্যা কমলার নামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বার্ষিক বক্তৃতামালা এখন কার্যত বিস্মৃত। রমেশচন্দ্রের চারটি পুরনো বক্তৃতা এক সঙ্গে মলাটবন্দি করে নতুন করে ছাপতে উদ্যোগী হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। একই সঙ্গে দীনেশচন্দ্র সিংহের সম্পাদিত পূর্ব বঙ্গের কবিগান-এর একটি খণ্ডও প্রকাশিত হয়েছে। দাম সামান্য রেখে বইমেলার মাঠে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টলে (২৪৪ নম্বর) যা বিশেষ আকর্ষণ। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তী উপাচার্য শান্তা দত্ত দে-র মতে, “এ হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত রত্নসম্ভার থেকে চয়ন করে একাধিক গ্রন্থ পুনর্মুদ্রণের উদ্যোগ!” তবে, শুধু পুরনো বই ছাপাই নয়, দেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়টির নতুন করে নিজেকে আবিষ্কারেরও এ এক প্রয়াস।
হাজরায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাপাখানার সুবিশাল বাড়ির সঙ্গে সারস্বত চর্চার সম্পর্ক দিন দিন যেন ক্ষীণ হয়ে আসছিল। ঐতিহ্যশালী বই প্রকাশের বাড়িটিতে একটা সময়ে শুধু প্রশ্নপত্র ছাপা হত বলেও সূত্রের খবর। শান্তার উৎসাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক চিন্ময় গুহের নেতৃত্বে সেই রত্নভান্ডার পুনরুজ্জীবনের তাগিদ দেখা যাচ্ছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনার উপদেষ্টাদের সভাপতি চিন্ময় বলছিলেন, “প্রথমে রমেশ মজুমদারের ‘কমলা বক্তৃতা’ এবং পূর্ব বঙ্গের কবিগানের বইটি দিয়ে আমাদের নতুন করে পথ চলা শুরু হল। চারপাশের সাংস্কৃতিক অ্যামনেশিয়ার (বিস্মরণ) মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাঁড়ারের আরও মণিমুক্তোয় আমরা হাত দিতে চাই।”
রমেশ মজুমদারের বক্তৃতা নতুন করে ছাপা নিয়ে ইতিহাসবিদ মহলের একাংশে কিছুটা বিভ্রান্তিও রয়েছে। জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদ বলে খ্যাত রমেশ মজুমদারকে একটা সময়ে ইতিহাসবিদদের একাংশ ‘সাম্প্রদায়িক’ তকমাও দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের বিভাগীয় প্রধান তথা ‘আশুতোষ অধ্যাপক’ অমিত দে কিন্তু স্পষ্ট বলছেন, “রমেশচন্দ্রকে নস্যাৎ করার চেষ্টা কিছু ইতিহাসবিদের হঠকারিতা। যার ফলে গেরুয়া শিবির ওঁকে আত্মসাতের চেষ্টা করে। দলমত নির্বিশেষে রমেশ এক জন অসামান্য পণ্ডিত ইতিহাসবিদ। শুধু তা-ই নয়, আজকের পারস্পরিক সম্পর্কের দুঃসময়ে কলকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও তিনি একটি সেতু।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য রমেশচন্দ্রের অবদান এবং খোলা মনের অসাম্প্রদায়িক সত্তা ঢাকার শিক্ষাজগতেও নন্দিত বলে অমিতের দাবি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে শীঘ্রই প্রফুল্লচন্দ্র পাল সম্পাদিত ‘প্রাচীন কবিওয়ালার গান’ এবং বরুণকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘বাংলা মুদ্রিত গ্রন্থের ইতিহাস’ (১৬৬৭-১৮৩৪)-ও প্রকাশ করা হবে। ইতিহাসবিদ তথা আলিপুর জেল মিউজ়িয়ামের কিউরেটর জয়ন্ত সেনগুপ্তও এই উদ্যোগটিকে স্বাগত জানিয়ে বলছেন, “কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপাখানার স্বমহিমায় ফেরা খুবই আনন্দের। আশা করব, নতুন বইও ওঁরা প্রকাশ করবেন।” বইমেলার পরে কলেজ স্ট্রিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের বইয়ের কাউন্টারেও বইগুলি পাওয়া যাবে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)