Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

প্যায়সা উঠাও, রুপিয়া দো

দেশ জুড়ে খুচরোর বাড়বাড়ন্তে তাঁরাও এতটাই নাজেহাল যে, কেউ এক-দু’টাকার মুদ্রা দিতে চাইলে সাধুরা পত্রপাঠ বিদায় করে দিচ্ছেন তাঁকে। কিন্তু আশীর্বাদপ্রার্থীরাও নাছোড়।

পুণ্যলোভী: বাবুঘাটে সাধুর হাতে দক্ষিণা। শনিবার। নিজস্ব চিত্র

পুণ্যলোভী: বাবুঘাটে সাধুর হাতে দক্ষিণা। শনিবার। নিজস্ব চিত্র

দেবজিৎ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৮ ০২:০৬
Share: Save:

খুচরো নিচ্ছেন না সাধুরাও!

দেশ জুড়ে খুচরোর বাড়বাড়ন্তে তাঁরাও এতটাই নাজেহাল যে, কেউ এক-দু’টাকার মুদ্রা দিতে চাইলে সাধুরা পত্রপাঠ বিদায় করে দিচ্ছেন তাঁকে। কিন্তু আশীর্বাদপ্রার্থীরাও নাছোড়। সাধু দান ফিরিয়ে দিলে অমঙ্গল হবে, এই আশঙ্কায় ফের কোঁচ়়ড় থেকে ভাঁজ করা ১০ টাকার নোট ধরিয়ে দিতেই মুখে হাসি সংসারত্যাগীর। ছাই মাখা চিমটে মাথায় ছুঁইয়ে ইষ্টদেবতার কাছে দাতাকে ভাল রাখার আবেদন করলেন তিনি।

এ ছবি বাবুঘাটের। গঙ্গাসাগর যাওয়ার আগে দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা সাধুরা জমা হয়েছেন সেখানে। পুণ্যার্থীদের ভিড় চলে এসেছে আকাশবাণীর সামনের মাঠেও। সেখানেই বাস দাঁড় করিয়ে কাপড়ের আড়ালে খাওয়াদাওয়া, জিরোনো থেকে মায় শৌচকর্মও।
এই আবহে গঙ্গাসাগরের মাটি ছোঁয়ার আগে যদি খানিক সাধুসেবার সুযোগ মেলে, তো মন্দ কী? কিন্তু দক্ষিণা দিতে গিয়েই বিড়ম্বনা! সাধুবাবার সামনে দু’টাকার মুদ্রা রাখতেই কার্যত খেঁকিয়ে উঠলেন গেরুয়াধারী। ‘প্যায়সা উঠা লো। রুপিয়া হ্যায় তো দো।’ (পয়সা উঠিয়ে নাও। টাকা থাকলে দাও)— সাধুর এই স্পষ্ট নিদান শুনে শাড়ির আঁচলের গিট খুলে পাঁচ টাকার নোট দিলেন ভিন্ রাজ্যের পুণ্যার্থী।

সাধুর নাম নাগজি রামদাস। দেওঘরের তপোবন এলাকায় একচিলতে জমিতে জনা তিনেক শিষ্যকে নিয়ে তাঁর আশ্রম। বছর পাঁচেক বাদে এসেছেন গঙ্গাসাগরে। তাঁর এক শিষ্য বলছিলেন, ‘‘পাহাড়ের কোলে আশ্রম হওয়ায় বছরভর দাওয়ায়-চাতালে সাপের আনাগোনা চলে। বাবা তাদের খুবই যত্ন করেন।’’ বোঝা গেল, সর্পকূল পরিবেষ্টিত হয়ে থাকার জন্যই সাধুর ওই রকম নাম। গঙ্গাসাগরে যাওয়ার পথে অবশ্য তাঁর ঝোলায়
কোনও সাপ নেই। শিষ্যের দোহাই, ‘‘বাবা ওদের শীতে জাগিয়ে রাখতে চান না। সব ক’টিকেই পাহাড়ে ঘুম পাড়িয়ে এসেছেন।’’

নাগজির মতোই খুচরো নিতে অনীহা হরিদ্বারের কাছে হৃষিকেশের লছমনঝোলা এলাকার সাধু অদ্বৈত ধর্মদাসের। গাঁজায় বুঁদ এই শিবসাধক জড়ানো গলায় যা বললেন, তার মর্মার্থ: আগে খুচরো বেচে দু’টো টাকা আয় হত। কিন্তু এ বার কেউ নিচ্ছে না। তাই তিনিও দক্ষিণা নোটে না পেলে ফিরিয়ে দিচ্ছেন আশীর্বাদপ্রার্থীদের।

নোট বাতিলের আগে পর্যন্ত খুচরো কেনার আখড়া ছিল বাবুঘাট।
প্রতি বছর এই সময়ে সাধুরা কলকাতায় এলেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে যাঁরা কমিশনের বিনিময়ে বাটা বিক্রি করেন, তাঁরা ভি়ড় জমাতেন বাবুঘাটে। সাধুদের কাছ থেকে খুচরো কিনে তা দোকানি, অটোচালক বা বাসের কন্ডাক্টরদের বেশি দামে বিক্রি করতেন বছরভর। এমনই এক জন কণিকা প্রসাদ বললেন, ‘‘আমরাই শুধু খুচরো কিনি, তা নয়। বাইরের রাজ্য থেকে যাঁরা আসেন, গঙ্গাসাগরে রওনা দেওয়ার আগে তাঁরাও আমাদের কাছ থেকে খুচরো কেনেন। কিন্তু এ বার বাটায় ভাটা। সকলের কাছেই খুচরো রয়েছে।’’ আর এক জন খুচরো বিক্রেতা দুলাল সাউয়ের কথায়, ‘‘আমার কাছেই এত খুচরো জমে রয়েছে যে, এ বার আর সাধুদের কাছে যাইনি। তীর্থযাত্রীদের মধ্যেও খুচরো কেনার উৎসাহ কম।’’

গঙ্গাসাগরে প্রতি পদে খুচরো লাগে পুণ্যার্থীদের। মকর সংক্রান্তির স্নান করার সময়ে তাঁরা গঙ্গায় মুদ্রা ছোড়েন, পাড়ে উঠে সারি দিয়ে বসা ভিক্ষুকদের দান করেন, এমনকী গরুর লেজ ধরে ‘বৈতরণী পার’ হওয়ার পরে দক্ষিণাও মেটান খুচরোয়। আর ওই খুচরো কুড়োতে এই ক’টা দিন কাঠের খাঁচায় চট জড়িয়ে বালি টেনে যায় এক দল ছেলেমেয়ে। সেই মুদ্রাই ফিরে আসে বাজারে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE