Advertisement
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪
পথযাপন

‘ট্যাক্সি-কাকু’ হাত নেড়ে ইশারায় ডেকে বলেছিল, ‘চল, তোকে খাওয়াব’

গ্রীষ্মের দুপুর হোক বা শীতের রাত, পথের ধারেই কেটে যায় জীবনচক্র। শিশু থেকে নারী, সকলেরই সঙ্গী নিরাপত্তাহীনতা। রাজ্য শিশু অধিকার রক্ষা কমিশন জানাচ্ছে, দু’বছর আগের ব্রেবোর্ন রোডের ঘটনার পরেই ফুটপাতের শিশুদের নিয়ে, বিশেষ করে শিশুকন্যা-কিশোরীদের নিরাপত্তা নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ করা হচ্ছে

রাতজাগা: ঘুমোচ্ছে ছোটরা, তাই পাশে পাহারায় পরিবারের অন্যেরা। শ্যামবাজারে। ছবি: সুদীপ ঘোষ

রাতজাগা: ঘুমোচ্ছে ছোটরা, তাই পাশে পাহারায় পরিবারের অন্যেরা। শ্যামবাজারে। ছবি: সুদীপ ঘোষ

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:৩৪
Share: Save:

একটা ট্যাক্সি এসে সামনে দাঁড়িয়েছিল। ‘ট্যাক্সি-কাকু’ হাত নেড়ে ইশারায় ডেকে বলেছিল, ‘চল, তোকে খাওয়াব।’ মাথা নেড়ে না বলার পরেও ‘কাকু’টা যেতে চায়নি। ‘ট্যাক্সিতে আয়। ঘুরতে নিয়ে যাব!’ কথাগুলো শোনামাত্রই উল্টো দিকে দৌড় দিয়েছিল বছর আটের রাণু দাস (নাম পরিবর্তিত)। রাণুর কথায়, ‘‘পালিয়ে মায়ের কাছে চলে এসেছিলাম।’’ দু’মাস আগের ঘটনা। কিন্তু এখনও কোনও ট্যাক্সি সামনে এসে দাঁড়ালে, ভয়ে থাকে রাণু। গড়িয়াহাট ব্রিজ সংলগ্ন এলাকার ফুটপাতে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে সে।

রাণুর মা সুশীলা (নাম পরিবর্তিত) বলেন, ‘‘মেয়ে বড় হচ্ছে। ভয় করে খুব।’’ পুলিশে খবর দিয়েছেন? সুশীলার উত্তর, ‘‘কী বলব! এ সব তো প্রায়ই হয়। কত বার বলব?’’ তবে সেই ঘটনার পর থেকে রাণু আর রাতে মায়ের কাছে শোয় না। কারণ, তারা যেখানে থাকে, সেই জায়গাটা তুলনামূলক ভাবে ফাঁকা। তাই গড়িয়াহাট উড়ালপুলের যে প্রান্তে ফুটপাতবাসীরা একসঙ্গে বাস করেন, সেখানে শুতে যায়। এক ফুটপাতবাসী জানালেন, দু’আড়াই বছরের শিশুকন্যাদের নিয়েই দুশ্চিন্তা কমে না, সেখানে সাত-আট বছরের মেয়েরা তো বড়!

রাজ্য শিশু অধিকার রক্ষা কমিশন জানাচ্ছে, দু’বছর আগের ব্রেবোর্ন রোডের ঘটনার পরেই ফুটপাতের শিশুদের নিয়ে, বিশেষ করে শিশুকন্যা-কিশোরীদের নিরাপত্তা নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ করা হচ্ছে। যদিও প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, যে সব ঘটনা নিয়ে শোরগোল হয়, সেগুলো বাদ দিয়ে প্রতি দিন, প্রতি রাতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা পুলিশ-প্রশাসন পর্যন্ত পৌঁছয় না। কমিশনের চেয়ারম্যান অনন্যা চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কোনও ঘটনার খবর জানতে পারলেই আমরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে পদক্ষেপ করি।’’

আসলে শৈশব-কৈশোর বলে কোনও একটা পর্যায় ফুটপাতের জীবনে থাকে কি না, তা নিয়েই তো সংশয়! ফুটপাতের শিশুদের নিয়ে বহু বছর ধরে কাজ করছে, এমন এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য বললেন, ‘‘শৈশব থাকবে কী ভাবে! আপনি হয়তো কোনও বাচ্চাকে পড়ানোর জন্য শিবিরে আনলেন, কিন্তু কিছু পরেই তার মা এসে ছেড়ে দিতে বলবেন। কারণ, ওরা তখন ভিক্ষা করবে!’’ মূলত রেল স্টেশন ও সংলগ্ন এলাকার ফুটপাথের শিশুদের নিয়ে কাজ করা আর এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য তিস্তা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শুধু মেয়েরাই নয়, আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, ছোট ছেলেরাও শারীরিক নিগ্রহের শিকার। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের লোকেরাই এ বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেন না!’’

ফলে প্রতি দিনই যেখানে টিকে থাকার লড়াই, সেখানে পড়াশোনা করা বা সেই ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করাটা যেন এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার! শোভাবাজারের ফুটপাতে মা-বোনের সঙ্গে থাকে ষোলো বছরের রাজু দাস। পড়াশোনা করে কি না, প্রশ্নের উত্তরে তার সাফ জবাব, ‘‘ধুর বোর হয়ে যাই!’’ এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্যের কথায়, ‘‘আমরাও যদি ছোটবেলায় কিছু কাজ করে হাতে পঞ্চাশ টাকা পেতাম, তা হলে কি আর পড়াশোনা করতাম!’’ তবে তার মধ্যেও মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা থাকে না, তা নয়! কিন্তু সে-সব ব্যতিক্রমই!

এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষে স্বাতী চক্রবর্তী বলেন, ‘‘পথশিশুরা আসলে ‘ইনভিজিবল পপুলেশন’! তবে, এরা যেন অস্তিত্বহীন। সরকারি প্রক্রিয়ায় সঙ্গে ওদের যুক্ত করার সব কাজই আমরা করছি। ওদের আধার কার্ড দেওয়ার প্রক্রিয়াকরণের কাজও শুরু করতে চলেছি।’’ ফুটপাতের শিশুদের জন্য, বিশেষত মেয়েদের জন্য বিশেষ বোর্ডিং স্কুল চালুর পরিকল্পনা করেছে কলকাতা পুরসভাও। পুরসভার মেয়র পারিষদ (শিক্ষা) অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘প্রস্তাবিত ওই বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনার ব্যবস্থা, খাওয়াদাওয়া-সহ সব কিছুই বিনামূল্যে দেওয়া হবে।’’

তবে যাবতীয় অনিশ্চয়তা বাদ দিয়ে ফুটপাতের জীবনে পাল্টা প্রতিরোধ তৈরি হয় রোজ, প্রতি রাতে। যার প্রমাণ পাওয়া গেল হেদুয়ার ফুটপাতে। ‘‘ভয় করবে কেন? ঝাঁটা থাকে তো! মেরে তাড়িয়ে দিই।’’ বয়স বড়জোর পনেরো বছর। শ্যামলা গায়ের রং। ডান হাতে উল্কি করা। পরনে পুরনো, নোংরা একটা চুড়িদার। তবে চোখেমুখে সামান্য দ্বিধাও নেই। রাতে ফুটপাথে থাকতে ভয় করে কি না, প্রশ্ন শোনামাত্রই রিয়া মাঝি নামে ওই কিশোরীর স্পর্ধিত উত্তর! যার সঙ্গে অনায়াসে মিশে গেল যাদবপুরের ফুটপাতের সতেরো বছরের কিশোরী রোশনি খাতুনের কথা। রোশনির কথায়, ‘‘মদ খেয়ে নেশা করে গায়ের উপরে পড়ে যায় লোকজন। মেরে তাড়াই তখন।’’

কিন্তু এ লড়াই তো নেশাগ্রস্তদের সঙ্গে লড়া যায়। কারণ, তাদের সমগোত্রীয় বলেই মনে করেন ফুটপাতবাসীরা। কিন্তু গাড়ি করে আসা ‘বাবু’গোত্রীয় অজ্ঞাতপরিচয় লোকজন, যাদের আনাগোনা বেড়ে যায় রাতের ফুটপাতে, তাদের সঙ্গে কি লড়া যায়? ভাল পোশাক পরা কাউকে চট করে কিছু বলা যায় না, জানাচ্ছেন ফুটপাতবাসীরা। তাই তখন দৌড়ে পালাতে হয়! যেমন ‘ট্যাক্সি-কাকু’র হাতছানিতে সাড়া না দিয়ে ছুটে পালিয়েছিল রাণু।

ফুটপাতের জীবন ওই বালিকাকেও বুঝিয়ে দিয়েছে কোন ডাকে সাড়া না দিয়ে পালাতে হয়।

অন্য বিষয়গুলি:

Girl Footpath Unsafe Insecurity
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy