অনেক নথিপত্র ঘেঁটে পাভলভ হাসপাতাল জানিয়ে দিল, মারা গিয়েছেন কাজলের মা। আর তার পরে কেটে গিয়েছে প্রায় ১৪ বছর।
২০০৩ সালের ১৬ অগস্ট নাম-পরিচয়হীন হিসেবে কাজলের মা ভর্তি হয়েছিলেন পাভলভে। আর পরের বছর ২১ সেপ্টেম্বর ওই হাসপাতালেই তিনি মারা যান বলে সেখান থেকে জানানো হয়। তাঁর দেহ চলে যায় নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
এই খবর পেয়ে কাজল চলে এসেছেন এনআরএসে। জানতে চেয়েছেন, কবে, কী ভাবে তাঁর মায়ের দেহ সৎকার করা হয়েছে? পরিচয়হীন কোনও ব্যক্তির দেহ এলে কি তার ছবি তুলে রাখা হয়? যদি রাখা হয়, তা হলে তাঁর মায়ের মুখের ছবিও কি তুলে রাখা হয়েছে? শুনেছেন, অজ্ঞাতপরিচয় বলেই তাঁর মায়ের দেহের ময়না-তদন্ত করানো হয়েছিল। সেই রিপোর্ট পেতে গেলে কী করতে হবে, তা-ও জানতে চান কাজল। তাঁর প্রশ্ন, ডেথ সার্টিফিকেট কি পাওয়া যাবে?
কাজলের কাছে মায়ের কোনও ছবি নেই। নামটাই শুধু মনে আছে— গীতা বিশ্বাস। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় সেই গীতাদেবী আট বছরের মেয়েকে নিয়ে জলপাইগুড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। সহায়, সম্বলহীন অবস্থায়। কাজলের কথায়, ‘‘শারীরিক ও মানসিক ভাবে এতটাই অত্যাচার হয়েছিল যে, বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন মা। বাবা আমাদের আর খোঁজ নেননি।’’
কলকাতা বিমানবন্দর এলাকার পরিত্যক্ত কোয়ার্টার্সে মায়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন কাজল। সেখানেই ভাইয়ের জন্ম। সেই ভাই, রাহুল, যখন বছর চারেকের, তখন ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারান গীতাদেবী। বিমানবন্দরে যাত্রীদেরও এক সময়ে আক্রমণ করতে শুরু করেন। কাজলের বয়স তখন মেরেকেটে ১২। ২০০৩ সালের অগস্ট মাসে একই দিনে একটি জিপে কাজল ও রাহুলকে এবং অন্য জিপে গীতাদেবীকে নিয়ে চলে যায় পুলিশ। কাজলদের ভর্তি করানো হয় সল্টলেকের এসওএস ভিলেজে। এসওএস ভিলেজের নথি জানাচ্ছে, কাজলেরা ২০০৩ সালের ১৬ অগস্ট ভর্তি হন সেখানে।
সেখানেই বড় হয়ে ওঠেন ভাইবোন। জানতেন না মায়ের পরিণতি। কাজল বড় হয়ে হোম থেকে বেরিয়ে এসে বিয়ে করেন। শুরু করেন মায়ের খোঁজ। বিমানবন্দর পুলিশের কাছে গিয়ে জানতে পারেন, তাঁর মাকে সেই সময়ে ভর্তি করা হয়েছিল পাভলভে। সেখানে ছোটেন কাজল। প্রথমে সেই হাসপাতালের নথি ঘেঁটে জানা যায়, ওই সময়ে বিমানবন্দর পুলিশ পাভলভে যে অজ্ঞাতপরিচয় মহিলাকে ভর্তি করিয়ে যায়, তিনি দশ মাসের মাথায় সুস্থ হয়ে ভাইয়ের সঙ্গে বসিরহাটে চলে গিয়েছেন। অবাক হন কাজল। পাভলভের সুপার, চিকিৎসক গণেশ প্রসাদকে তিনি জানান, এখানে তাঁর কোনও মামা নেই। আর মা সুস্থ হয়ে গেলে তাঁদের খোঁজ করতেন নিশ্চয়ই। আবার নথি ঘাঁটতে শুরু করেন গণেশবাবু। শেষে জানা যায়, ওই ১৬ অগস্ট বিমানবন্দর থানা থেকে অন্য আর এক জন মহিলাকেও ভর্তি করিয়ে যাওয়া হয়। তিনিও অজ্ঞাতপরিচয়। দিনক্ষণ মিলে যাওয়ায় মনে করা হচ্ছে, ওই মহিলাই কাজলের মা। তিনি ২০০৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মারা যান। দেহ পাঠিয়ে দেওয়া হয় নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
সেখান থেকেই এ বার বিস্তারিত তথ্য চান কাজল। সোমবার হাসপাতালে আবেদনপত্র জমা দিয়ে বেরোনোর সময়ে বিড়বিড় করে বলতে থাকেন, ‘‘আসলে একটা ছবি পেলে ভাল হত। হতেই তো পারে, এঁরা যাঁর কথা বলছেন, সেই মহিলাও আমার মা নন। কোথাও হয়তো এখনও বেঁচে আছেন...।’’ গলাটা বুজে আসে তাঁর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy