‘সুজন গাছে বাঁধালে হাঁড়ি/ মিলবে আসল চিনি...’ সার বুঝেছিলেন সাধক কবি। বাঙালির শীতের শ্রেষ্ঠ ফসল নলেন গুড়ের পরতে পরতে এমন গভীর জীবন-দর্শন। প্রিয়তম সুরভিটুকু আগের থেকে ফিকে কি? সন্দেহ ঘনিয়ে উঠলেও তার কাছে নিঃশর্ত সমর্পণই বাঙালি জন্মের ভাগ্যলেখা। করোনাকালের দুর্বিপাকে জীবন মরুভূমি হলেও, খেজুর গাছের প্রাণভোমরা অমৃতরসটুকু এ বছর আরও খোলতাই, বলছেন সমঝদারেরা। কলকাতার মিষ্টি-স্রষ্টাদের দরবারে তাই এখন জোর আনাগোনা হাঁসখালি, বহড়ু, বসিরহাট, কাটোয়া কি দইহাটের গুড় চাষির। নকুড়, বলরাম বা রিষড়ার ফেলু ময়রার বিশেষজ্ঞ কর্তা চোখ বুজে বলে দেবেন, কোনটা নিখাদ, কোনখানে আখের গুড়ের পাইলিংয়ে ভেজাল মিশেছে। পায়েস, মোয়া থেকে সন্দেশ, কাঁচাগোল্লায় কেমন গুড় বা পাটালির প্রয়োগ মোক্ষম, তা নিয়েও তত্ত্বের ছড়াছড়ি। বচ্ছরকার এই শীত-সুরভিটুকু আবহমান, তবু চিরনতুন।
লোকশিল্প নিয়ে
রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক মহাবিদ্যালয় নরেন্দ্রপুরের (স্বশাসিত) বাংলা বিভাগের উদ্যোগে গড়ে উঠছে একটি লোকসংস্কৃতি চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র। উদ্দেশ্য, নানা লোকশিল্পবস্তু প্রদর্শনের পাশাপাশি গবেষকদের লোকসাহিত্য ও শিল্পচর্চার পরিসর গড়ে তোলা। কারুশিল্প, মৃৎশিল্প, কাঠ ও শোলা শিল্প-সহ হস্তশিল্পের সম্ভার সংরক্ষণ করবেন ওঁরা। থাকবে চড়িদার ছৌ মুখোশ, পাঁচমুড়ার ঘোড়া, ডোকরা, পিংলার পট, নকশি কাঁথা, কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল, লৌকিক দেবদেবীর মূর্তি ও ছলন, সরা, ঘট, প্রদীপ, বাদ্যযন্ত্র, ঢেঁকি, কৃষি সামগ্রী, পালকি, নৌকা, ঘোড়া ও গরুর গাড়ি, হাতে টানা রিকশা ইত্যাদি। লোকগবেষক ও সংগ্রাহকদের নাম-ঠিকানা, ছবি, গ্রন্থতালিকা সংগ্রহের কাজ চলছে, লোকশিল্পীদের ছবি ও পঞ্জি, পুথি-পাণ্ডুলিপি চয়নও। লোকশিল্পীদের অনুষ্ঠান ছাড়াও সেমিনার, কর্মশালা, ক্ষেত্রসমীক্ষার উদ্যোগ করা হবে, আছে লোকসাহিত্য ও গ্রাম সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে সার্টিফিকেট কোর্সের ভাবনাও। প্রদর্শশালা ও গ্রন্থাগারের জন্য লোকসামগ্রী, বই, পত্রিকার খোঁজে আছেন ওঁরা, দাতার নামেই সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত হবে সযত্নে।
ছোট ছবির বিশ্ব
ছোট ছবি আকারে ছোট হতে পারে, কিন্তু দর্শকের মনে তার প্রভাব ছোট নয় মোটেই। সবাই মিলে ছোট ছবি দেখা ও সেই নিয়ে অর্থবহ সংযোগ ও সংলাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে, চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শকগোষ্ঠী ও ছবি-করিয়েদের একত্রে মেলাতে চাইছে ‘ক্যালকাটা ইন্টারন্যাশনাল শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’। ব্রিটিশ কাউন্সিল ইন্ডিয়া-র সহযোগিতায়, কলকাতার ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম সোসাইটি’-র উদ্যোগে আয়োজিত এই ছবি-উৎসব শুরু হচ্ছে ১৮ ডিসেম্বর, চলবে ২০ তারিখ পর্যন্ত। থাকছে ৪৩টি দেশের স্বাধীন ও পেশাদার ছোট ছবি-করিয়েদের তৈরি অ্যানিমেশন-ছবি, ‘এক্সপেরিমেন্টাল শর্টস’, তথ্যচিত্র-সহ মোট ৯৬টি ছোট ছবি। অনেকগুলি ছবিই বিশ্বের বিভিন্ন ছবি-উৎসবে সাড়া ফেলেছে। উদ্যোক্তারা আয়োজন করেছেন কর্মশালা ও বেশ কয়েকটি মাস্টারক্লাস, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণে একটি বিশেষ সাম্মানিক পুরস্কারও। উৎসব-সূচি ও বিশদ তথ্য জানা যাবে ‘ক্যালকাটা ইন্টারন্যাশনাল শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এর ফেসবুক পেজ এবং ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম সোসাইটি’র ওয়েবসাইটে।
যায় যায় দিন
পুজোর দিন গোনা? মহালয়া থেকে শুরু। মধ্যবিত্তের মাইনের দিন গোনা? মাইনে পাওয়ার পরের দিন থেকে। পায়ের-তলায়-সর্ষের নেক্সট ট্রেকিংয়ের দিন গোনা, ফিরতি ট্রেন হাওড়ার প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে না ঢুকতেই। পেশা বয়স রুচি-ভেদে দিন গোনার রকমসকম আলাদা, শুধু এ বছরটাই বোধহয় বিরল ব্যতিক্রম। গোটা দুনিয়া দিন গুনছে: কবে যাবি বাবা ২০২০? এখনও আধ মাস! আগামী বছর কী হবে, কী ভাবে ও কতটা, অজানা। তবু, এই দুঃসহ ক্যালেন্ডার বিদেয় হোক।
এই বাড়িতেই জন্ম ‘সন্দেশ’-এর
তাঁর জীবনে তৎকালীন সুকিয়া স্ট্রিটের ২২ নম্বর বাড়িটির ভূমিকা অপরিসীম। কলকাতায় কর্নওয়ালিস স্ট্রিট (এখন বিধান সরণি), শিবনারায়ণ দাস লেন প্রভৃতি জায়গায় ভাড়াবাড়িতে থাকার পর বিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে ২২ সুকিয়া স্ট্রিটের (এখন ৩০বি মহেন্দ্র শ্রীমানি স্ট্রিট) বাড়িতে (ছবিতে) সপরিবার উঠে আসেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। ১৮৯৫ নাগাদ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজস্ব ছাপাখানার। তখনও পর্যন্ত এ দেশে অপরিজ্ঞাত হাফটোন ব্লকের নিখুঁত ছবি ছাপানোয় তাঁর মুদ্রণালয়ের সুনাম দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ফলে ছাপাখানা ও ছবি আঁকার স্টুডিয়োর প্রয়োজনে বড় বাড়ির সন্ধানে তাঁকে এখানে আশ্রয় নিতে হয়। গবেষক সিদ্ধার্থ ঘোষ তাঁর টুনটুনির বই ও ইউ. রায় এন্ড সন্স প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, এত দিন পর্যন্ত তাঁর মুদ্রণালয় ‘ইউ রায়, বিএ, আর্টিস্ট’-এর নামে বিজ্ঞাপিত হলেও এ বাড়িতে আসার পরই প্রথম ১৯১০ সালে প্রবাসী পত্রিকায় এক বিজ্ঞাপনে ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ মেলে। ওই বছরই টুনটুনির বই প্রকাশের মাধ্যমে সংস্থাটি প্রকাশনা-ব্যবসাতেও নাম লেখায়। এই বাড়ি থেকেই উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, সুখলতার অনেক কালজয়ী বই প্রকাশের মুখ দেখেছে। পরে গড়পার রোডে নিজস্ব বসতবাটী প্রতিষ্ঠা করে তিনি এই সংস্থাকে সেখানে সরিয়ে নিয়ে যান, সত্যজিৎ রায় যা চিত্রিত করে চিরস্থায়ী করে রেখেছেন। সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিকতার অভিযাত্রা শুরু এখান থেকেই। সন্দেশ পত্রিকার জন্মও এ বাড়িতে।
নীচের তলায় পশ্চিমাংশে ছিল ছাপাখানা। ওপরে দক্ষিণ দিকে থাকতেন উপেন্দ্রকিশোর। তাঁর সহোদর, বিপত্নীক কুলদারঞ্জনও তিন সন্তানকে নিয়ে থাকতেন। এই বাড়ির ‘স্মৃতির ছবি’ও দুর্লভ নয়। উপেন্দ্রকিশোর-তনয়া পুণ্যলতা চক্রবর্তী বাড়ির স্টুডিয়োর ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। লীলা মজুমদার শুনিয়েছেন ছাপাখানার মেশিনের শব্দ, রং-কালির গন্ধে মোহময় আবেশের কথা।
১৯১৪ সালে প্রবাসী-র বিজ্ঞাপনে উপেন্দ্রকিশোরের মুদ্রণালয় গড়পার রোডে স্থানান্তরের হদিস মেলে। সে বছর ডিসেম্বর-শেষে বা পরের বছর জানুয়ারির গোড়ায় ২০ কর্নওয়ালিস স্ট্রিট থেকে এখানে চলে আসে ‘কাম্তিক প্রেস’, যেখানে মুদ্রিত হত ভারতী পত্রিকা। প্রেসের স্বত্বাধিকারী ও ভারতী-র নবনির্বাচিত সম্পাদক মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত আড্ডা বসত এ বাড়ির তেতলার ঘরে। হেমেন্দ্রকুমার রায়, নলিনীকান্ত সরকার, সুধীরচন্দ্র সরকারের লেখায় আছে সে কথা। সবুজপত্র, মৌচাক, নাচঘর প্রভৃতি সাময়িকপত্রের প্রকাশস্থানও এই বাড়ি। ২০ ডিসেম্বর উপেন্দ্রকিশোরের প্রয়াণদিন, তাঁর স্মৃতিবহ কলকাতার সাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটি।