কারও আজীবনের সঞ্চয়ের ধন। কারও কাছে ‘পয়মন্ত’। ফেলে দিতে মন চায় না। কিন্তু উপায় কী? অকেজো গাড়ি নিয়ে কী করবেন? কোথায় যাবেন? চেষ্টা করেও গাড়ি সারানো যাচ্ছে না। মেরামতির খরচ শুনে কারও পকেটে টান পড়ছে। কেউ টাকা ঢেলেও গাড়ি বাঁচাতে পারছেন না। ঘোর দুঃসময়ে অগতির গতি ‘সার্ভিস সেন্টার’। সেপ্টেম্বরের এক রাতের দানবীয় বৃষ্টির পরে প্রায় এক মাস কেটে গিয়েছে। কলকাতার সারাই-খানাগুলি এখনও গাড়িতে গাড়িতে ছয়লাপ। এই ‘জগদ্দল’দের নিয়ে এক পক্ষের নাভিশ্বাস উঠছে, অন্য পক্ষ খেয়ে যাচ্ছে লাভের গুড়!
গত ২২ সেপ্টেম্বর রাত থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর সকাল পর্যন্ত কলকাতায় ২৫১ মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টিতে জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল বহু রাস্তা। বাড়ির গ্যারাজে, রাস্তার ধারে বা পার্কিংয়ে দাঁড় করানো শয়ে শয়ে গাড়ি জলে ডুবে গিয়েছিল। যা কলকাতার সাম্প্রতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন!
আরও পড়ুন:
বেনজির সেই বিপর্যয়ের মুদ্রার দু’টি পিঠ রয়েছে। এক পিঠে অর্থহানি। অন্য পিঠে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’।
জলমগ্ন কলকাতার রাস্তায় আধোডোবা গাড়ি। ছবি: পিটিআই।
একরাতের বৃষ্টিতে যে বিপর্যয় ঘটেছিল, প্রায় এক মাস কেটে যাওয়ার পরেও তার অভিঘাত সামলে উঠতে পারেনি সার্ভিস সেন্টারগুলি। এত গাড়ি একসঙ্গে খারাপ হয়েছে যে, তা মেরামত করার উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই! অনেকে সারাই-খানা থেকে গাড়ি ফেরত নিয়েও যেতে চাইছেন না। তাতে অবশ্য সার্ভিস সেন্টারের মালিকদের লাভই হয়েছে। যদিও কাজের চাপে তাঁরা হিমশিম খাচ্ছেন বলে একটু অনুযোগও করছেন! কিন্তু তাঁদের ঠিক বিপ্রতীপে রয়েছেন গাড়ির মালিকেরা। জলমগ্ন রাস্তা থেকে গাড়ি তুলে সার্ভিস সেন্টার পর্যন্ত পাঠাতে যেমন তাঁদের বিপুল অর্থব্যয় করতে হয়েছে, তেমনই সেই গাড়ি সারিয়ে আনতেও জলের মতো টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। বিমা সংস্থাগুলির সাহায্য নিতে গিয়েও দেখছেন ‘জটিলতা’ তৈরি হচ্ছে। কাঁটার মতো তাঁদের গলায় বিঁধে রয়েছে অকেজো গাড়ি।
সমস্যায় পড়েছে বিমা সংস্থাগুলিও। মুম্বইয়ে কয়েক বছর আগে তুমুল বৃষ্টিতে রাস্তাঘাটের সঙ্গে ডুবেছিল প্রচুর বিলাসবহুল গাড়ি। তার পর থেকে গাড়ির বিমাপত্রে অন্যান্য ক্ষতির সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগকেও জুড়ে দেওয়া হয়েছে (যদিও বন্ধের মতো ঘোষিত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গাড়ি বার করে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিমায় তার টাকা পাওয়া যায় না)। তার জন্য বিমার দরও বেড়েছে।
চারচাকার গাড়ি যাঁরা চালান, তাঁরা জানেন, জল জমার তিনটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম পর্যায়, অর্থাৎ গাড়ির চাকার মাঝামাঝি পর্যন্ত জল উঠলে তেমন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। গাড়ির মূল যন্ত্রপাতি, ইঞ্জিন থাকে নীচের অংশেই। ফলে দ্বিতীয় পর্যায়ে, অর্থাৎ চাকার উপর পর্যন্ত জল উঠলেই ক্ষতি। সে ক্ষতি তো হয়েছেই, বহু গাড়ি জানালা পর্যন্ত ডুবে গিয়েছিল। বিভিন্ন বহুতল আবাসনের বেসমেন্টে যে সমস্ত গাড়ি রাখা ছিল, সেগুলির ছাদ পর্যন্ত জল উঠেছে। সেখানে ক্ষতি ষোলোআনা।
বৃষ্টির জমা জলে গাড়ির নীচের অংশ ডুবে গিয়েছে। ছবি: পিটিআই।
এই বিপর্যয়ে একতরফা মুনাফা কুড়িয়েছে গাড়ি উদ্ধারকারী সংস্থাগুলি (টোয়িং কোম্পানি)। রাস্তায় রাস্তায় জলে ডুবে থাকা গাড়ি তুলে দিতে গিয়ে তারা কোথাও দ্বিগুণ, কোথাও চারগুণ বেশি দর হেঁকেছে। বেসমেন্ট থেকে শুধু ডুবে থাকা গাড়ি বার করতে কোথাও কোথাও চাওয়া হয়েছে ১০ হাজার টাকা! বাইপাসের এক পার থেকে অন্য পারে গাড়ি নিয়ে যেতে লেগেছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। দর কষাকষির সময় বা ধৈর্য ছিল না গাড়ির মালিকদের। ফলে দুর্যোগের পরের পাঁচ-ছ’দিনেই উদ্ধারকারী সংস্থার মালিকেরা পাঁচ-ছ’মাসের অর্থ এক ধাক্কায় উপার্জন করে নিয়েছেন। পার্ক সার্কাসের এমনই এক সংস্থার মালিক শেখ সাহেব আলমের কথায়, ‘‘পাঁচ-দশ দিনের জন্য আমরা অনেক লাভ করেছি। তবে টাকা তো অন্য পাঁচদিনের চেয়ে একটু বেশি নিতেই হবে! বহু গাড়ি খারাপ অবস্থায় ছিল। এমন এমন রাস্তায় গা়ড়ি আটকে ছিল যে, উদ্ধারের জন্য ক্রেন ঢোকানো যায়নি। আমাদের বাড়তি কর্মী নিয়োগ করতে হয়েছে। সাধারণত আমরা দিনে এক থেকে দুটো গাড়ি উদ্ধার করি। সেখানে ওই সময়ে রাত জেগে কাজ করতে হয়েছে।’’
উদ্ধারকারীদের কাছে অবশ্য এখনও ফোন আসছে। সার্ভিস সেন্টারগুলিতে যেহেতু আর জায়গা নেই, তাই অনেক অকেজো গাড়ি এখনও সরানো যায়নি। কালিকাপুরের এক সার্ভিস সেন্টারের মালিক গোবিন্দ মণ্ডল বলেন, ‘‘২৫ বছর ধরে এই কাজ করছি। বর্ষাকালে আর পুজোর আগে সাধারণত আমাদের কাজের চাপ কিছুটা বেশি থাকে। কিন্তু এত চাপ আগে কখনও আসেনি। দ্বিগুণের বেশি কাজ এসেছে। আমাদের কাছে গাড়ি রাখার আর জায়গা নেই। দিনরাত এক করে কাজ করছি। ব্যবসা ভাল হচ্ছে, তবে খাটনিও প্রচুর।’’ বাইপাসের কাছাকাছি এক সার্ভিস সেন্টারের মালিক সিদ্ধার্থ মাল। তাঁর গলাতেও একই সুর। বললেন, ‘‘৩০ বছরের ব্যবসায় এমন কখনও দেখিনি। আমপান বা অন্য দুর্যোগের সময়েও এই পরিস্থিতি হয়নি।’’ সল্টলেকের একটি মেরামতি সংস্থার মালিক অর্চিৎ খন্না জানাচ্ছেন, স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ বেশি গাড়ি সারানোর বরাত এসেছে তাঁদের কাছে। তবে যত গাড়ি সারাতে পেরেছেন, তার চেয়েও বেশি ফিরিয়ে দিতে হয়েছে।
গাড়ি খারাপ হলে সাধারণত বিমা সংস্থার দ্বারস্থ হন মালিকেরা। এ ক্ষেত্রে এত গাড়ি খারাপ হয়েছে যে, বিমা সংস্থা টাকা দেওয়ার আগে ‘উপযুক্ত প্রমাণ’ চাইছে। দুর্যোগগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ির ছবি তুলে না-রাখায় অনেকে বিমার টাকা পাচ্ছেন না। সেই গাড়িগুলিও সার্ভিস সেন্টারের জায়গা দখল করে পড়ে আছে। তা ছাড়া, গাড়ির বয়স এবং উপযোগিতা অনুযায়ী বিমা সংস্থাগুলি তার জন্য যে মূল্য নির্ধারণ করছে, অনেক ক্ষেত্রে তা-ও ছাপিয়ে যাচ্ছে গাড়ি মেরামতের খরচ! সারাইয়ের জন্য উপযুক্ত ‘পার্টস’ মিলছে না। অনেক গাড়ি আটকে আছে সে কারণেও।
৬০-৭০ লক্ষ টাকার বিলাসবহুল গাড়ির ইঞ্জিনের দামই লাখ দশেক। জল ঢুকে বেশির ভাগ গাড়ির ইঞ্জিন বিগড়েছে। ইঞ্জিনে জল ঢুকে গাড়ি অকেজো হয়ে পড়লে তাকে বলে ‘হাইড্রোলক্ড ইঞ্জিন’। সার্ভিস সেন্টারগুলিকে গাড়ি থেকে বালতি বালতি জল বার করতে হয়েছে। দামী গাড়ির কার্পেটের নীচে যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈদ্যুতিক ‘মডিউল’ থাকে। আসনের নীচে থাকে বাড়তি ব্যাটারি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সেই সব অংশে। কেউ কেউ নিজে থেকে স্থানীয় গ্যারাজে গাড়ি নিয়ে গিয়ে সেগুলি সারিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল করেছেন। গাড়ি সারানোর খরচই লক্ষাধিক। যে গাড়ি যত বেশি আধুনিক, তার ক্ষতি তত বেশি। সেগুলি সারাতে খরচও তত বেশি!
যাঁদের নিজস্ব সার্ভিস সেন্টার রয়েছে, তাঁরা ইচ্ছেমতো লাভ করছেন। এক-একটি গাড়ি সারানোর জন্য যেমন খুশি পারিশ্রমিক চাইছেন। গাড়ি অনেকের কাছেই আবেগের। অনেকে তাই টাকার মায়া করছেন না। অনেকে ভাবছেন, ভাঙা লোহালক্কড়ের দরে গাড়ি বিক্রি করে দেবেন। তাঁরা আছেন সর্বনাশে। সার্ভিস সেন্টার আর উদ্ধারকারী সংস্থা পৌষমাসে।