কাজল বর্মণ ও ধৃত লিঙ্কন দাস। মঙ্গলবার। — নিজস্ব চিত্র
এ কেমন আসা!
অষ্টমঙ্গলায় বাড়ি আসবে পরিবারের ছোট মেয়ে। নতুন পোশাক কিনে এনেছিলেন বাবা। শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়ে-জামাইকে আনতে গাড়ির ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। মঙ্গলবার, অষ্টমঙ্গলার সন্ধ্যাতেই বাড়ি এল মেয়ে। নতুন শাড়িতে নয়, সাদা কাপড়ে ঢেকে। গাড়ির বদলে শববাহী শকটে। হাসি-হুল্লোড়ের বদলে কান্নার রোল উঠল সোদপুর পিয়ারলেস নগরের বর্মণ পরিবারে।
পুলিশ জানায়, গত মঙ্গলবারই বাড়ির ছোট মেয়ে কাজল বর্মণের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বাগুইআটির লিঙ্কন দাসের। সোমবার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে খবর আসে, বাগুইআটির এক নার্সিংহোমে কাজলের মৃত্যু হয়েছে। স্তম্ভিত হয়ে যায় গোটা পরিবার।
কাজলের বাড়ির লোকেদের অভিযোগের ভিত্তিতে মঙ্গলবার লিঙ্কন, তাঁর বাবা নারায়ণচন্দ্র দাস এবং মা কৃষ্ণা দাসকে গ্রেফতার করেছে বাগুইআটি থানার পুলিশ। বর্মণ পরিবারের অভিযোগ, বিয়ের পর থেকেই পণের দাবিতে কাজলের উপরে নানা ভাবে অত্যাচার চলছিল। বাপের বাড়ির কারও সঙ্গে যোগাযোগেও বাধা দেওয়া হচ্ছিল। এ দিন কাজলের স্বামী ও শ্বশুরের চার দিনের পুলিশ হেফাজত এবং শাশুড়ির ১৫ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
তদন্তকারীরা জানান, বাগুইআটির অশ্বিনীনগরে কাজলের শ্বশুরবাড়ি। সোমবার সন্ধ্যায় সেখান থেকেই ওই তরুণীকে নার্সিংহোমে নিয়ে যান তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। কিন্তু আগেই মৃত্যু হয়েছিল কাজলের। নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ থানায় খবর দিলে পুলিশ গিয়ে কাজলের দেহ নিয়ে আসে। আটক করা হয় তাঁর স্বামী, শ্বশুর এবং শাশুড়িকে। জেরায় তাঁরা পুলিশকে জানান, কাজল গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এতে সন্দেহ হয় পুলিশের। কেন থানায় খবর না দিয়ে কাজলের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাঁকে নার্সিংহোমে নিলেন, তার সদুত্তর মেলেনি বলেই পুলিশের দাবি। ওই রাতে সাড়ে তিনটের পরে কাজলের বাড়ির তরফে বধূ-হত্যার অভিযোগ দায়ের করা হয়। তার পরেই অভিযুক্ত তিন জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
কাজলের দাদা তপন বর্মণের দাবি, তাঁর বোনকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘সোমবার সন্ধ্যায় প্রথমে আমাদের জানানো হয়, বোন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাঁকে নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ ফের জানানো হয়, বোন গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।’’ ওই তরুণীর দেহে গলার দু’পাশে কালশিটের চিহ্ন মিলেছে বলে পুলিশ সূত্রে খবর। যা খুনের তত্ত্বকেই জোরালো করছে বলে তদন্তকারীদের একাংশের মত।
ওই তরুণীর বাবা লক্ষ্মীকান্ত বর্মণের অভিযোগ, গত বৃহস্পতিবার বৌভাতের পরদিন থেকেই কাজলের উপরে অত্যাচার শুরু হয়। তিনি বলেন, ‘‘১০ লক্ষ টাকা নগদ, গাড়ি, আই ফোন— সব কিছুই চাওয়া হচ্ছিল। মেয়ের উপরে শারীরিক, মানসিক নানা ভাবে অত্যাচার করা হতো। মেয়ে রোজ লুকিয়েচুরিয়ে ফোন করে কান্নাকাটি করত। হোয়্যাট্সঅ্যাপেও জানাত। গত শনিবার আমরা ওর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সময় চেয়েছিলাম। কিন্তু তার মধ্যেই মেয়েটাকে যে ওঁরা মেরে ফেলবেন, ভাবতেই পারিনি।’’
পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন দেখে গত দুর্গাপুজোর পরে অশ্বিনীনগরের ওই পরিবারের একমাত্র ছেলে, পেশায় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার ইঞ্জিনিয়ার লিঙ্কনের সঙ্গে কাজলের বিয়ে ঠিক হয়। এ দিন তপন জানান, লিঙ্কনের সঙ্গে তাঁর বোনের বয়সের ব্যবধান অনেকটাই। অনেক দিন চেষ্টার পরে বোনের বিয়ের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়।
এদিন অশ্বিনীনগরের ওই পাড়ায় গিয়ে জানা যায়, দাস পরিবারের সঙ্গে পাড়ার লোকেদের তেমন যোগাযোগ ছিল না। কাজলের পরিবারের তরফেও বলা হয়, গত বৃহস্পতিবার বৌভাতে কন্যাযাত্রী হিসেবে গিয়ে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরাও। ওই তরুণীর এক আত্মীয় অমিত চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা জনা কুড়ি লোক গিয়েছিলাম বৌভাতে। কিন্তু সেখানে পাড়ার লোকজন, ছেলের বন্ধুবান্ধব কাউকেই দেখতে পাইনি।’’ প্রতিবেশীরা এ-ও জানিয়েছেন বিয়ের পর থেকেই গোলমাল চলছিল কাজল ও লিঙ্কনের।
পুলিশ অবশ্য জানিয়েছে, ধৃতেরা বারবারই দাবি করে চলেছে যে, কাজলকে খুন করা হয়নি। আত্মহত্যাই করেছেন তিনি। এমনকী, কাজলের বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল বলেও পুলিশের কাছে দাবি করেছেন তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা।
পুলিশ সূত্রে খবর, এ দিন ময়না-তদন্তের পরে পিয়ারলেস নগরের বাড়িতে এসে পৌঁছয় কাজলের দেহ। শোকস্তব্ধ অষ্টমঙ্গলার বাড়িতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা মেঘমালা দেবী— ‘‘কী ভাবে মেয়েকে পাঠিয়েছিলাম। আর কী ভাবে বাড়ি এল মেয়ে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy