Advertisement
E-Paper

ইফতার যেন পড়শিকে চেনার আরশিনগর

সাহিনা বলছিলেন, ‘‘ধর্ম মেনে রোজা সবাই রাখতে পারেন না, কিন্তু ইফতারে সবাইকে নিয়ে এক সঙ্গে চলার বার্তায় ফাঁক রাখতে চাই না।

ঋ়জু বসু

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৮ ০২:৪৭
স্বাদ: রাজাবাজারে ইফতারের আসর। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

স্বাদ: রাজাবাজারে ইফতারের আসর। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

রমজানে রোজার শেষে রাত জেগে নমাজের পরেও ক্লান্তি নেই ছিটেফোঁটা। রাজাবাজারে নারী অধিকাররক্ষার লড়াইয়ের কর্মী সাহিনা জাভেদ-তাহসিনা বানোরা মিলে দিনভর ‘চিকেন প্যান্ত্রাস’ ভাজতে মশগুল।

সদ্য স্নাতক শামা পারভিন পেঁয়াজি-বেগুনি ভাজায়, কলেজ ছাত্রী আলফিসা-আলিসা-মেহজবিনেরা ছোলা সেদ্ধ তৈরি করতে ব্যস্ত। সন্ধ্যায় ঝেঁপে আসা বৃষ্টিকে তুড়ি মেরে বন্ধু সায়ন্তনী, অঙ্কিতা, আনন্দরা ইফতারের সময়ে পৌঁছতেই আয়োজকদের চোখ-মুখ খুশিতে উজ্জ্বল। রূপান্তরকামী পুরুষ অঙ্কন বিশ্বাস, রূপান্তরকামী নারী রঞ্জিতা সিন্‌হা, অ্যাসিড আক্রান্ত তরুণী সঞ্চয়িতা যাদবদের দলটাও সামান্য দেরিতে হাজির।

মোটেও গুরুগম্ভীর পরিবেশ নয়। ঘড়ি-ধরা সময়ে রোজাদারদের দোয়া শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করলেন অতিথিরা। সক্কলে পাশাপাশি পাত পেড়ে বসে ‘বন্ধু কী খবর, বল’-মেজাজেই খাওয়াদাওয়া শুরু।

সাহিনা বলছিলেন, ‘‘ধর্ম মেনে রোজা সবাই রাখতে পারেন না, কিন্তু ইফতারে সবাইকে নিয়ে এক সঙ্গে চলার বার্তায় ফাঁক রাখতে চাই না।’’ ইফতারের এই মিলনমেলাকে কলকাতার নানা রঙা সংস্কৃতির খোলা ক্যানভাস হিসেবেই মেলে ধরছেন তাঁরা। রাজাবাজারের এই মেয়েরা একা নন, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে অন্য মাত্রা পাচ্ছে ইফতারের আসর। সমাজকর্মী সাবির আহমেদ, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহম্মদ রিয়াজরা ধারাবাহিক ভাবেই শহরের বিভিন্ন মুসলিম মহল্লায় ঢুকে মেলামেশার ডাক দেন বৃহত্তর নাগরিক সমাজকে। মোমিনপুর, হাওড়ার বাজেশিবপুরে পিএম বস্তি অথবা নারকেলডাঙার খালপাড়ের রমজানি সাঁঝও যেন হয়ে ওঠে পড়শিকে চেনার আরশিনগর।

কিছু দুর্লভ দৃশ্যেরও জন্ম হল! সন্তোষপুরের সুমন সেনগুপ্ত পাঁচ বছরের মেয়ে করতোয়াকে সঙ্গে নিয়ে মোমিনপুরে গিয়েছিলেন। বললেন, ‘‘পড়শির সংস্কৃতির একটা স্বাদ তো পেল মেয়েটা! আমাদের বন্ধু সাবির-সাফিনার পুঁচকে ছেলে, ওর সমবয়সী সাকিফের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হল।’’ বাজেশিবপুরে হাওড়ার বন্ধ চটকলের সাফাইকর্মী, মজুরদের নিয়ে ৬০০ জনের খাবার আয়োজনও মুখের কথা নয়! পাড়ার মঞ্জু কাকিমা, মালবিকা-ইন্দ্রাণী বৌদিরা বাড়ির পুজোর বঁটিতে নিষ্ঠা ভরে ফল কাটতে বসে গেলেন। সুইডেনের সাংবাদিক জেনি নিরামিষাশী। মোমিনপুরে নানা কিসিমের বাঙালি তেলেভাজার স্বাদে পুলকিত তিনিও!

গ্রামবাংলার ইফতারের কিছু গল্প কলকাতাকে শোনালেন কাকদ্বীপের তরুণ সাহেবুল হক। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, মোমিনপুরের মেয়ে হিবা আহমেদ আফশোস করছিলেন, ‘‘রাজনৈতিক নেতাদের ইফতারে শুধুই প্রভাবশালী অতিথিদের ডেকে তেলা মাথায় তেল দেওয়ার প্রবণতা। এর ফলে, ইফতারে গরিব-বড়লোকের ফারাক ভুলে খাবার ভাগ করে খাওয়ার মাধুর্যটা সকলে বোঝে না।’’

বাজেশিবপুরে মুখুজ্জেদা, পালবাবু, ঘোষবাবুদের মতো পড়শিদের উদ্যোগের শরিক হয়েছেন সাজি়দ ভাই, আনসারি সাহেবরা। খোঁজ পড়ল, কাছে-দূরের বন্ধুরা কে কী সাহায্য করতে পারেন। রুআফজ়া সরবত, ফলের কিছুমিছু কিংবা ডেকরেটরের সরঞ্জামের জন্য জুটেও গেল ছোট-ছোট ‘স্পনসর’! অত লোকের জন্য চিকেন হালিমের থেকে বেশি কিছু অবশ্য রেস্তয় কুলোয়নি। সর্বজনীন রুচিমাফিক চিকেন হালিমটাই ইদানীং বেশি ভোট পাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক ইমানুল হককে এই ইফতারের সুবাদেই খাল ধারের বাচ্চাদের জন্য বাড়ির হেঁসেলে রাতভর ডাল ভিজিয়ে রেখে খুন্তি নাড়তে দেখা গেল।

ছোট-বড় সব ইফতার-আসরে সাধ্যমত সব কিছুর আয়োজন করেছেন পাড়ার লোকেরাই। আমরা-ওরা ভাগাভাগির বাঁচা ভুলে বিনি সুতোর বাঁধনটাই শেষ কথা বলে গেল।

Iftar Eid Festival
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy