Advertisement
E-Paper

কী কর্ম কার, ঠিক করে দেওয়ার ‘দেব’ তিনিই

দেওয়াল ভেঙে বেড়াল ঢোকার ব্যবস্থা করেছিলেন আবাসনের বাসিন্দারাই। সেই বেড়ালই ক্রমশ বাঘ হয়ে উঠল। আবাসন জুড়ে এখন তারই দাপট। নিজের ফ্ল্যাট রং করাবেন? কিংবা বদলাতে হবে শৌচাগারের ভাঙা কল? কাজ করবে ‘তাঁর’ ঠিক করে দেওয়া মিস্ত্রি। কবে করবে? তা-ও ঠিক করে দেবেন ‘তিনি’ই।

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:০৪
জয়দেব কর্মকার। — নিজস্ব চিত্র

জয়দেব কর্মকার। — নিজস্ব চিত্র

দেওয়াল ভেঙে বেড়াল ঢোকার ব্যবস্থা করেছিলেন আবাসনের বাসিন্দারাই। সেই বেড়ালই ক্রমশ বাঘ হয়ে উঠল। আবাসন জুড়ে এখন তারই দাপট।

নিজের ফ্ল্যাট রং করাবেন? কিংবা বদলাতে হবে শৌচাগারের ভাঙা কল? কাজ করবে ‘তাঁর’ ঠিক করে দেওয়া মিস্ত্রি। কবে করবে? তা-ও ঠিক করে দেবেন ‘তিনি’ই।

তিনি উত্তর দমদম পুরসভার ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর জয়দেব কর্মকার। সব কাজে যাঁর অঙ্গুলিহেলনের ব্যবস্থা করে দিতে এলাকার ২৪ বছরের পুরনো ওই সরকারি আবাসনের সোসাইটিতে তৈরি হয়ে গিয়েছে আস্ত একটা নতুন পদ— ‘আবাসনের সৌন্দর্যায়নের লক্ষ্যে উন্নয়ন কমিটির সভাপতি’। প্রায় হাজার বাসিন্দার ওই আবাসনে তিনি এখন সদা সর্বদা বিরাজমান। একজন দায়িত্ববান কাউন্সিলরের মতোই তিনি সর্বদা নাগরিকদের ‘সুরক্ষা’র কথা ভাবেন।

আর সেই ‘সুরক্ষা’র জন্যই আবাসনে কার্যত সিন্ডিকেট খুলে ফেলেছেন তিনি। যে কোনও ফ্ল্যাটে যে কোনও কাজ করাতে তাঁর অনুমতি চাই তো বটেই, নিতে হবে তাঁর ঠিক করে দেওয়া মিস্ত্রিকেই। অন্য আবাসিকেরাই জানাচ্ছেন, যদি সেই মিস্ত্রির কাজ পছন্দ না হয়, তবে কাজ বন্ধ করতে হবে। কিন্তু বিকল্প মিস্ত্রির ব্যবস্থা নৈব নৈব চ। আবাসনের এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘বিকল্প মিস্ত্রি পাবই বা কোথায়? এই আবাসনে তো কেউ কাজ করতেই চান না।’’

কেন আসেন না অন্য মিস্ত্রিরা?

২০১৫-এর আগে ওই আবাসনে যে সব মিস্ত্রি কাজ করতেন, তাঁদের দাবি— স্থানীয় কাউন্সিলর ও শাসক দলের নেতা জয়দেব কর্মকারের নির্দেশ, ‘‘ওঁর এলাকায় কাজ করতে হলে টাকা দিতে হবে।’’ কখনও খরচ দিতে হবে তৃণমূলের মিটিং-এর খাওয়া-দাওয়ার, আবার কখনও জোগাতে হবে দলের কর্মীদের পিকনিকে যাওয়ার খরচ। মিস্ত্রিদের কথায়, ‘‘ব্যবসার টাকা এ ভাবে চলে যাওয়ার চেয়ে কাজ না করা ভাল।’’ আর যে সব মিস্ত্রি এখন কাজ করছেন, তাঁদের কথায়— ‘‘বাড়তি টাকা তো আর নিজেদের পকেট থেকে দিতে পারব না। তাই যে বাড়িতে কাজ করছি, তাঁদের থেকেই বাড়তি টাকা নিতে বাধ্য হচ্ছি।’’

মিস্ত্রিদের থেকে শুধুই টাকা তোলা নয়। সেই সঙ্গেই রয়েছে মারধর করার মতো অভিযোগও। এলাকার বাসিন্দারাই বলছেন, দুর্গাপুজোয় তাঁর পছন্দ মতো আলোকসজ্জা না হলে মণ্ডপে দাঁড়িয়ে সেই কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিকে চড় মারতেও দ্বিধা করেন না জয়দেব। এক আবাসিকের কথায়, ‘‘এঁরা সবাই নিজেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন।’’ এমনকী, অনেক বাসিন্দার অভিযোগ, আবাসনের পার্কগুলি সাজাতে যে কাঁচা মাল ব্যবহার হয়েছে, তা-ও এসেছে জয়দেবেরই ভাইয়ের দোকান থেকে।

ওই আবাসনে জয়দেবের ‘আবির্ভাব’ ২০১৩ সালে। আবাসনের ‘অরাজনৈতিক’ সোসাইটির নির্বাচনে জয়ী নতুন সদস্যরা তাঁকে আবাসনের ‘সৌন্দর্যায়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া’র জন্য সভাপতি করেন। আবাসনের বাসিন্দাদের একাংশ জানান, আগে আবাসনে সৌন্দর্যায়নের জন্য সভাপতি কেউ ছিলেন না। জয়দেবই প্রথম। তখন তিনি আবাসনে ‘বহিরাগত’। অনেক বাসিন্দার আপত্তি সত্ত্বেও ওঁকেই সভাপতি করা হয়।

সরকারি আবাসনের সোসাইটিতে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব নতুন ঘটনা নয়। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পালাবদল হলে আবাসিকদের কমিটিতেও তার আঁচ পড়ে। সেই অঙ্কেই ২০১১-র পরে কমিটিতে ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছেন তৃণমূল সমর্থক সদস্যরাই।
জয়দবকে সভাপতি করে আনার নেপথ্যেও তাঁরাই।

কিন্তু ‘বহিরাগত’ হয়েও জয়দেব কর্মকারকে সভাপতি করা হল কেন?

সোসাইটির এক সদস্যের কথায়, ‘‘আমাদের নির্বাচনে জিততে উনি সাহায্য করেছিলেন। ওঁর শর্তই ছিল জিতলে ওঁকে আবাসনে ঢোকাতে হবে।’’ শর্ত মতো নতুন পদও বানানো হয় ‘সৌন্দর্যায়নের সভাপতি’। আবাসনের এক বাসিন্দা তথা স্থানীয় তৃণমূল কর্মী বলেন, ‘‘ওকে ছাড়া সিপিএমকে সরাতে পারতাম না। তাই উনি যা বলছেন, তা-ই মেনে নিতে হচ্ছে।’’ তিনি জানান, ২০১৫ সাল থেকে জয়দেববাবু আবাসনেই থাকছেন।

ফলে তাঁর বিরুদ্ধে কোনও কথা বলবেন এমন ‘অসীম সাহসী’ তাঁর দলের বাইরে বা ভিতরে কেউ নেই। কাকতালীয় ভাবে হোয়াট্‌সঅ্যাপেও জয়দেব নিজের ডিপি হিসেবেও ব্যবহার করেছেন বাঘের ছবি! আবাসনের সোসাইটির অন্য সদস্যেরা জানান, আবাসনের উন্নতির জন্যই কাজ করছেন জয়দেব। তবে, প্রকাশ্যে না বললেও আড়ালে তৃণমূলেরই বেশ কিছু কর্মীর বক্তব্য, ‘‘খাল কেটে কুমির এনেছি। উনি তো কোনও দিনই এই আবাসনের বাসিন্দা ছিলেন না। এখন উনিই সব।’’

কিন্তু আবাসনের সৌন্দর্যায়নের সভাপতি হিসেবে জয়দেববাবু কি আবাসনের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন?

এক সদস্যের কথায়, ‘‘বাসিন্দারা কাকে দিয়ে ফ্ল্যাট রং করাবেন আর কাকে দিয়ে কল সারাবেন— সেটা তাঁদের ব্যাপার। তাঁরা কমিটিকে জানাবেন। কিন্তু কমিটি মিস্ত্রি ঠিক করে দিতে পারে না। এখন জয়দেবদার কথাতেই সব হচ্ছে। আমরাও তা-ই করছি। কারণ, উনি রাগ করলে আমরাও টিকে থাকতে পারব না।’’ যদিও অনুমতি দানের কাজ চলে ব-কলমে। জয়দেব কর্মকার রাজি হলে তবেই আবাসনে যে কোনও কাজের অনুমতি দেন সোসাইটির সেক্রেটারি ভাস্বর রায়চৌধুরী। যদিও ভাস্বরবাবুর দাবি, ‘‘এ সমস্ত ভিত্তিহীন অভিযোগ। ব্যক্তিগত আক্রোশে অনেকে অনেক কিছুই বলছেন। হাউসিং সোসাইটি স্বশাসিত। সব সিদ্ধান্ত সোসাইটির সব সদস্য মিলেই নিই।’’

কাউন্সিলর জয়দেব কর্মকার অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা কোনও অভিযোগই স্বীকার করেননি। শুধু বলেছেন, ‘‘আমি যা করছি, আবাসনের ভালর জন্যই।’’

syndicate raj syndicate councillor tmc
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy