পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে হিন্দিভাষী ভোটারদের মন জয় করতে মরিয়া শাসকদল তৃণমূল। গত লোকসভা নির্বাচনে অবাঙালি হিন্দু ভোট গিয়েছে বিরোধী বিজেপির বাক্সে। তাই এ বার উত্তর ভারতের প্রসিদ্ধ উৎসব দেব দীপাবলিকে বড় কলেবরে তুলে ধরে সেই ভোটারদের কাছে পৌঁছে যাওয়ার কৌশল নিয়েছে শাসকদল। এই পর্যায়ে কলকাতা পুরসভা ও তৃণমূলের অবাঙালি কাউন্সিলরদের সামনে আনা হচ্ছে। যদিও দু’বছর আগেই বাজে কদমতলা ঘাটে দেব দীপাবলির উদ্যাপনের সূচনা করে কলকাতা পুরসভা। সে ক্ষেত্রেও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দক্ষিণ কলকাতার দাপুটে হিন্দিভাষী তৃণমূল নেতা তারক সিংহকে। এ বারও তাঁর তত্ত্বাবধানেই বাজে কদমতলা ঘাটে আরও বড় আকারে দেব দীপাবলি উৎসব হচ্ছে। অন্য দিকে, উত্তর কলকাতার ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিজয় উপাধ্যায় আবার কলকাতার আটটি গঙ্গার ঘাটকে নিয়ে দেব দীপাবলি আয়োজনে উদ্যোগী হয়েছেন।
বছর দুয়েক আগে থেকেই ছট-পরবর্তী সময়ে দেব দীপাবলি পালনের আয়োজন শুরু হয়েছে শহরে। বেনারসের কাশী বিশ্বনাথ ঘাটের আদলে দক্ষিণ কলকাতার বাজা কদমতলা ঘাট সাজিয়ে তোলা হয়। কার্তিক পূর্ণিমার রাতে আলো, সঙ্গীত ও ভক্তির মেলবন্ধনে গঙ্গার ঘাটে ফুটে উঠবে কাশীর এক টুকরো প্রতিচ্ছবি। আগামী বুধবার দেব দীপাবলির তিথি। ওই দিন পুরসভার সহযোগিতায় দেবত্বের জয়চণ্ডী ঠাকুরানি ট্রাস্ট করবে পুজো ও সন্ধ্যারতি।
ইতিমধ্যেই অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি জোরকদমে চলছে। প্রায় ১০ লক্ষ টাকার সরঞ্জামের বরাত দিয়েছে পুরসভা। তার মধ্যে ৫ লক্ষ টাকা খরচ করে আসছে ১০ হাজারেরও বেশি ইলেকট্রনিক প্রদীপ, যা দিয়ে গোটা ঘাট সাজানো হবে আলপনার সঙ্গে। দুপুর থেকেই শুরু হবে গঙ্গার পুজো ও মহাযজ্ঞ। সন্ধ্যা নাগাদ চলবে ঘণ্টাখানেকব্যাপী গঙ্গারতি। ৫ হাজারেরও বেশি ভক্ত ও দর্শনার্থীর মধ্যে ভোগ বিতরণের আয়োজন থাকছে। বিশেষ ভোগ হিসাবে থাকবে খিচুড়ি, পোলাও, আলুর দম, চাটনি ও পায়েস। পাশাপাশি থাকবে নাচ-গানের অনুষ্ঠানও। বাজে কদমতলা ঘাট ও আশপাশের এলাকা সাজানো হবে আলোয়। বসানো হবে বড় এলইডি স্ক্রিন, যেখানে সরাসরি দেখানো হবে গঙ্গা আরতির দৃশ্য।
তৃণমূল কাউন্সিলর বিজয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এই উৎসবের আনুষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয়েছে ‘দেব দীপাবলি উৎসব এবং মা গঙ্গার আরতি’। বুধবার সন্ধ্যায় ভূতনাথ মন্দিরের পাশে নিমতলা বিসর্জন ঘাট থেকে শুরু করে সম্মিলিত আহিরীটোলা ঘাট পর্যন্ত আলোকমালায় সাজিয়ে তোলা হবে। ২১ হাজার প্রদীপ দিয়ে এই গঙ্গার পারকে সাজিয়ে তোলা হবে ওই দিন। ঘটনাচক্রে, বিজয় দীর্ঘ দিন সমাজবাদী পার্টি সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০০৬ সালে মেট্রো চ্যানেলে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুরের জমি ফিরিয়ে দেওয়া নিয়ে যে অনশন কর্মসূচি শুরু করেছিলেন, তাতে একটা সময় পর্যন্ত মমতার সহযোগী ছিলেন এই বিজয়। ২০১৫ সালের পুরসভা নির্বাচনের আগে সমাজবাদী পার্টি ছেড়ে যোগদান করেন তৃণমূলে। ওই নির্বাচনে সিপিএম নেতা তথা প্রাক্তন সাংসদ সুধাংশু শীলের বিরুদ্ধে তাঁকে প্রার্থী করানো হলে জয়ী হন বিজয়। ২০২১ সালের পুরসভা নির্বাচনেও ২০ নম্বর ওয়ার্ড থেকেই আবার কাউন্সিলর হয়েছেন তিনি।
নিজের এমন আয়োজন প্রসঙ্গে অবাঙালি এই নেতা বলছেন, ‘‘উত্তর ভারত, বিশেষ করে বিহার, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে দেব দীপাবলি এক জনপ্রিয় উৎসব। পশ্চিমবঙ্গের ওই রাজ্যের অনেক বাসিন্দায় স্থায়ী ভাবে বসবাস করেন। কলকাতায় সে ভাবে দেব দীপাবলির আয়োজন হয় না বলে তাঁরা সেই উৎসব থেকে বঞ্চিত থেকে যান। সেই সমস্ত মানুষের কথা মাথায় রেখেই আমরা এই আয়োজন করেছি।’’ বিজয় আরও বলেন, ‘‘কার্তিক মাসের এই পূর্ণিমা তিথিতেই মহাদেব ত্রিপুরাসুরকে বধ করেছিলেন। সেই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে দেবলোকে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। সেই ধারা থেকে উত্তর ভারতে এই উৎসবের আয়োজনের সূত্রপাত। দিদি আমাকে পুরসভা নির্বাচনের টিকিট দেওয়ার পর বলেছিলেন, তোমাকে জয়ী হয়ে এখানকার অবাঙালি স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য কাজ করতে হবে। তাই জয়ী হওয়ার পর থেকেই আমি সব সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য কাজ করছি। এই উৎসব তেমনই কাজের একটি অংশ।’’
প্রসঙ্গত, নিমতলা ঘাট থেকে আহরিটোলাঘাট পর্যন্ত দেব দীপাবলি উপলক্ষে আরতির জন্য বেনারস থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাঁচ জন ব্রাহ্মণকে আনা হয়েছে। যাঁরা ওই দিন গঙ্গা আরতি করবেন বলে জানিয়েছেন কাউন্সিলর বিজয়। প্রসঙ্গত, হিন্দুধর্মালম্বীদের কাছে কার্তিক পূর্ণিমার দিনটি বিশেষ ভাবে শুভ। এ প্রসঙ্গে সর্বভারতীয় প্রাচ্যবিদ্যা আকাদেমির অধ্যক্ষ জয়ন্ত কুশারী বলেন, ‘‘দিন পনেরো আগে আমরা দীপাবলি উৎসব পালন করলাম। মূলত দীপান্বিতা আমাবস্যার দিন কালী বা মা তারার উদ্দেশে দীপদান করা হয়। আর রাসপূর্ণিমার আগের তিথিকে আমরা বৈকুণ্ঠ চতুর্দশী বলি, যে দিন স্বর্গলোকে দেব দীপাবলি উৎসব হয়। মা লক্ষ্মী এবং নারায়ণের উদ্দেশে এই উৎসব হয়। দেবলোকের সেই উৎসব আমরাও পালন করতে পারি। আগে বাংলায় এই উৎসব বহুল প্রচলিত ছিল না। এখন বাংলায় এই উৎসবের প্রচলন হচ্ছে, এটা একটা ভাল বিষয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ধর্মীয় ব্যাখ্যায় এই উৎসবের অর্থ হচ্ছে, রথযাত্রার পরের একাদশী তিথি, অর্থাৎ শয়ন একাদশীতে বৈকুণ্ঠলোকে ঘুমোতে যান নারায়ণ। আর কার্তিক একাদশীর শুক্লা তিথি, অর্থাৎ উত্থান একাদশীতে তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠেন। যে কারণে স্বর্গলোকে দেব দীপাবলি হয়। সেই তিথি মেনে উত্তর ভারতে বহু যুগ ধরে এই উৎসব হয়ে আসছে। এটা ভারতে নতুন কোনও বিষয় নয়।’’