মায়ের করা ফোনই আরও বড় বিপদ থেকে বছর চোদ্দোর নাবালিকাকে কার্যত বাঁচিয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। এসএসকেএম হাসপাতালের ট্রমা কেয়ার বিল্ডিংয়ের শৌচাগারে নাবালিকা ধর্ষণের ঘটনার তদন্তে নেমে প্রাথমিক ভাবে পুলিশ জানতে পেরেছে, অভিযুক্ত অমিত মল্লিক চিকিৎসকের পোশাকে ওই নাবালিকাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার অজুহাতে ডেকে নিয়েছিল। তারপর ‘স্টাফ টয়লেট’ লেখা ঘরে তাকে ধর্ষণ করে। পুলিশ জেনেছে, ওই টয়লেটে ঢোকার কয়েক মিনিটের মধ্যেই নাবালিকাকে ফোন করেন তার মা। তাতেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয় সে। শনিবার নাবালিকার মা বলেন, ‘‘ভাগ্যিস সময় মতো ফোন করেছিলাম। নয় তো খারাপ কাজের পরে আমার মেয়েকেও হয়তো খুন করে ফেলা হত। আমার ফোনই ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।’’
এই ঘটনায় ধৃত অমিত কী ভাবে চিকিৎসকের পোশাক পেল, সেই প্রশ্ন ঘুরছে। পুলিশ সূত্রের খবর, অতিমারির সময় অস্থায়ী কর্মী হিসাবে কলকাতা পুলিশ হাসপাতাল এবং এসএসকেএম হাসপাতালের অ্যানেক্স বিল্ডিং শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে কাজ করেছিল সে। সেই সময়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের পোশাক তার কাছে ছিল। এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে যে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পুলিশ পেয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, তার গায়ে নীল রঙের পোশাক ছিল। যা সাধারণত চিকিৎসকদের পরতে দেখা যায়। মাথায় ছিল অস্ত্রোপচারের ঘরে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীরা পরেন, এমন ‘কাপড়ের টুপি’। গলায় মাস্ক ঝুলছিল। ওই পোশাকে এসএসকেএমের ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’-তে (আইওপি) দাঁড়িয়ে নাবালিকার সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় অমিতকে। নাবালিকাকে তার সঙ্গে হেসে কথা বলতেও দেখা গিয়েছে। তখন নাবালিকার দাদু কিছুটা দূরে ছিলেন। এরপর নাবালিকাকে অমিতের সঙ্গে হেঁটে যেতে দেখা যায়। হাসপাতালের মধ্যেই নাবালিকা কয়েকশো মিটার অমিতের পিছনে হেঁটে যায়।
ট্রমা কেয়ার বিভাগের যে পথ দিয়ে জরুরি পরিস্থিতিতে রোগীদের প্রবেশ করানো হয়, সে দিক দিয়ে না গিয়ে কিছুটা ঘুরে ট্রমা কেয়ার বিভাগের পাশের দিকের দরজা দিয়ে নাবালিকাকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে অমিত। এরপর একতলায় সিটি স্ক্যান ও এমআরআই-এর জন্য বরাদ্দ ঘরের উল্টোদিকে ‘স্টাফ টয়লেট’ (হাসপাতাল কর্মীদের ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ) লেখা দরজা। সেখানেই প্রথমে অমিতকে এবং তার পিছনে নাবালিকাকে প্রবেশ করতেদেখা যায়।
পুলিশের দাবি, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফোন কানে নিয়ে নাবালিকাকে বেরিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে। তদন্তকারী দলে থাকা পুলিশের এক অফিসার বলেন, ‘‘মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছে বলেই নাবালিকাকে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল অভিযুক্ত। সহজ মনে সেটা বিশ্বাস করেই নাবালিকা গিয়েছিল। কিন্তু তার ফল যে এমন হতে পারে, ভাবেনি।’’
অমিত এক পরিচিতকে দেখানোর জন্য ওই পোশাক পরে ঘটনার দিন এসএসকেএম হাসপাতালে উপস্থিত হয়েছিল বলে যে দাবি করেছে, তা সঠিক নয় বলেও মনে করছে পুলিশ। সন্দেহ করা হচ্ছে, অন্য উদ্দেশ্যে সে হাসপাতালে গিয়েছিল। এই প্রেক্ষিতেই হাসপাতালে রোগী ভর্তির দালাল চক্রের সঙ্গে অমিতের যুক্ত থাকার তত্ত্ব সামনে আসছে। পুলিশ জানিয়েছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জেরার মুখে পুরো ঘটনার কথা ধৃত যুবক স্বীকার করেছে বলেও পুলিশের দাবি। একই সঙ্গে ওই ঘটনার জন্য সে অনুতপ্ত বলেও পুলিশের একাংশের দাবি। জেরায় সে জানিয়েছে, ঘটনার পরেই বাড়ি ফিরে বিষয়টি সে স্ত্রীকে জানায়। এই দাবি কতটা সত্যি প্রশ্ন উঠছে। কেন সে নিজে থেকেই পুলিশের দ্বারস্থ হল না, উঠছে সেই প্রশ্নও?
অনেকেই বলছেন, যেখানে হাসপাতালের ভিতরে অবাধে ঘোরাঘুরির সুযোগ থাকার কারণেই আর জি করে চিকিৎসক পড়ুয়াকে খুন ধর্ষণের মতো ঘটনা একজন সিভিক ভলান্টিয়ার ঘটাতে পেরেছিল বলে উঠে এসেছে, সেখানে তার পরেও কেন প্রশাসন সতর্ক হল না? কেন যথাযথ পরিচয়পত্র ছাড়া এখনও কেউ হাসপাতালে অবাধে ঘুরে বেড়াতে পারে উঠছে সেই প্রশ্নও। এ দিনই এসএসকেএম হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন রাজ্যের শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন তুলিকা দাস। তিনি বললেন, ‘‘প্রচুর মানুষ রোজ হাসপাতালে আসেন। কার কী অভিপ্রায় বোঝা মুশকিল। তবে নিশ্চিত ভাবেই একটা ঘৃণ্য ঘটনা ঘটেছে। আর কী করলে নিরাপত্তা আরও কঠোর হতে পারে, সেই সংক্রান্ত পরামর্শ আমরাসরকারকে পাঠাব।’’
এর মধ্যে এ দিনই আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অমিতের মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষা হয়েছে, ডিএনএ পরীক্ষার জন্য তার রক্তের নমুনাও সংগ্রাহ করা হয়েছে। হাসপাতালের ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে এই পরীক্ষা হয়েছে বলে সূত্রের খবর। এ দিন বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদঅভিযুক্তকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ফরেন্সিক মেডিসিন ও টক্সিকোলজি দফতরের চিকিৎসকেরা প্রায় ঘণ্টা তিনেক ধরে অমিতের পরীক্ষা করেন। প্রসঙ্গত,শুক্রবারই আলিপুর পকসো আদালতে অমিতের মেডিকোলিগাল পরীক্ষা এবং ডিএনএ পরীক্ষার জন্য রক্তের নমুনা সংগ্রহের আবেদন করেছিল পুলিশ। বিচারক আবেদন মঞ্জুর করেছিলেন। পুলিশ সূত্রের খবর, অমিতের মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। ঘটনার সময়ের সে কোনও ভিডিয়ো রেকর্ড করেছিল কি না, তাও খতিয়েদেখা হচ্ছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)