পাঁচ মাস হয়ে ছ’মাসে পড়ল। তবু কলকাতায় চার-চারটি মহিলা থানায় এখনও পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে পাঁচ-ছ’টির বেশি অভিযোগ জমা পড়েনি। তা হলে কি মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ ‘সিটি অব জয়’-তে কমে গিয়েছে?
কলকাতার ৬৯টি ‘সাধারণ’ থানায় নথিবদ্ধ হওয়া অভিযোগের খতিয়ান কিন্তু সে কথা বলছে না। অভিযোগ আসলে জমা পড়ছে না কেবল মহিলা থানাগুলোতেই, আর সে কথা স্বীকার করে নিচ্ছেন লালবাজারের কর্তারা।
কলকাতা পুলিশের চারটি ডিভিশনের প্রতিটিতে একটি করে মহিলা থানার উদ্বোধন হয় এ বছরের ২৭ জানুয়ারি। পাটুলি, টালিগঞ্জ, ওয়াটগঞ্জ ও আমহার্স্ট স্ট্রিট। আর পাঁচ মাস পর লালবাজারের কর্তাদের উপলব্ধি হয়েছে যে, মহিলা থানা বলে কিছুর কথা বহু নাগরিকেরই জানা নেই! তাঁদের কাছে এই তথ্যটুকুই নেই যে, মহিলারা যাতে নিজে থানায় গিয়ে অভিযোগ জানাতে সহজ ও স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, সেই জন্য মহিলা থানা তৈরি করা হয়েছে।
তা ছাড়া, পুলিশকর্তাদের একাংশ মেনে নিচ্ছেন, আটঘাট না বেঁধেই নবান্নের শীর্ষ মহলকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে কোনও রকমে তাড়াহুড়ো করে ওই সব থানা তৈরি করা হয়েছে। এ কথা মাথায় রাখা হয়নি যে, পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডেও পুলিশে যেখানে মহিলা ১৫ শতাংশ, সেখানে কলকাতা পুলিশ বাহিনীতে মাত্র চার শতাংশ মহিলা! সাধারণ থানায় দায়ের করা অভিযোগের ধরন ও গুরুত্ব বুঝে সেটা মহিলা থানায় পাঠানোর কথা। কিন্তু এই ধরনের সমন্বয়, যোগাযোগ ও ছুটোছুটি করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রমীলা পুলিশ কোথায়!
মহিলা থানা উদ্বোধনের সময়ে প্রতিটি মহিলা থানায় ইনস্পেক্টর পদমর্যাদার এক জন ওসি, এসআই ও এএসআই মিলিয়ে ১০ জন এবং ১৫ জন কনস্টেবল নিয়োগের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু লালবাজারের একটি সূত্রের খবর, এখনও প্রতিটি মহিলা থানায় এক জন ওসি, দু’জন এসআই এবং পাঁচ জন কনস্টেবল ও পাঁচ জন হোমগার্ড রয়েছেন। এই অবস্থায় যে মানের কাজ হওয়ার কথা, সেটাই হচ্ছে। আবার এক ধরনের জটিলতাও তৈরি হয়েছে একই এলাকায় একটি সাধারণ থানার পাশাপাশি একটি মহিলা থানা তৈরি হওয়ায়।
সাধারণ থানার ওসি তাঁর এলাকায় প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারী। কলকাতার পুলিশ কমিশনারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ওই ক্ষমতা ভোগ করেন। মহিলা থানার ওসি-র কিন্তু সেই ক্ষমতা নেই। একটি থানা এলাকায় দু’জন পুলিশ আধিকারিকের একই রকম প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকার কথাও নয়। কাজেই, মহিলা থানা অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ থানার মুখাপেক্ষী। আবার লোকবল কম থাকার কারণেও সাধারণ থানার উপর তাদের ভরসা করতে হয়। অর্থাৎ সব মিলিয়ে মহিলা থানা স্বাবলম্বী নয়। স্বনির্ভর মহিলা থানা তৈরি করতে যে ধরনের পরিকাঠামো প্রয়োজন, সে সব তৈরি না করেই মহিলা থানা করায় সমস্যা হচ্ছে বলে পুলিশের একাংশের মত।
লালবাজারের এক কর্তার কথায়, ‘‘শহরের চার প্রান্তে চারটি মহিলা থানা কোনও রকমে তৈরি করে দিলেই মহিলাদের সুবিধে হবে, তেমন ভাবার কারণ নেই।’’ তিনি জানাচ্ছেন, মহিলা থানার উপর ভরসা করা যায়, সেই বোধটাও বহু নাগরিকের মধ্যে এখনও তৈরি হয়নি। কোনও বাড়ির মহিলা হয়তো নিজের কোনও সমস্যা নিয়ে অভিযোগ জানাতে চান। বাড়ির মহিলা সদস্যেরাই বহু ক্ষেত্রে তাঁকে মহিলা থানায় যেতে বারণ করেন, বলেন, ‘ওখানে গিয়ে লাভ নেই।’
এই অবস্থায় মহিলা থানার ব্যাপারে লাগাতার প্রচার শুরু করতে চলেছে লালবাজার। যুগ্ম কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকার বলেন, ‘‘শহর জুড়ে বিভিন্ন ফ্লেক্স টাঙিয়ে সেগুলোর মাধ্যমে মহিলা থানার ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে অবগত করা হবে।’’ সেই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়া, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ও কলকাতা পুলিশের ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও জবরদস্ত প্রচার করা হবে বলে সুপ্রতিমবাবু জানান।
লালবাজারের আর এক শীর্ষকর্তা যুক্তি দিচ্ছেন, ‘‘যে কোনও নতুন জিনিস শুরু করতে গেলে কিছু সমস্যা হবেই। তবে আপাতত প্রচারের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজন মতো মহিলা পুলিশের সংখ্যাও ওই চারটি থানায় বাড়ানো হবে।’’
জানুয়ারি মাসে চারটি মহিলা থানা উদ্বোধন করার সময়ে ঘোষণা করা হয়েছিল, শীঘ্রই আরও চারটি ওই রকম থানা হবে বাকি চারটি ডিভিশনে। কিন্তু লালবাজারের কর্তাদের একাংশ চাইছেন, আগে পুরনো চারটি থানাতেই ঠিকঠাক কাজ হোক, মানুষ জানুক যে মহিলা থানায় কী কী সুবিধে পাওয়া যায়— তার পর নতুন থানা গঠনের কথা ভাবা যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy