আজ মহালয়া। শোভাবাজার রাজবাড়িতে বৃহস্পতিবার তারই প্রস্তুতি। — দেশকল্যাণ চৌধুরী
পুজোর মণ্ডপ কিংবা প্রতিমার সাবেকিয়ানায় বদল এসেছে বহু দিনই। এ বার কি বদলে যাচ্ছে বাঙালির পুজোর ‘বাদ্যি’ও!
বাঙালি এক সময়ে পুজো বুঝতো মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠ, সুপ্রীতি ঘোষ-দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়দের গান দিয়ে। পুজোর দিনগুলিতে মণ্ডপে মণ্ডপে মাইকে বাজত হেমন্ত-মান্না-কিশোর-রাহুল দেববর্মণ-লতা-আশার পুজোর গান। মাঝেমধ্যে তুমুল স্বরে ঢাকের বোল!
পুজোর ময়দান বলছে, থিম পুজোর হাত ধরে বদলে যাচ্ছে বাঙালির পুজোর গানও। এক সময়ে নামী-অনামী শিল্পীরা পুজোর সময়ে ‘বেসিক’ গানের রেকর্ড বার করতে উঠেপড়ে লাগতেন। এখন শহরের নামী পুজোয় থিম সঙ্গীত গান এ শহর এমনকী দেশের নামী শিল্পীরাও। ঢাকের বদলে এখন আবার মণ্ডপে মণ্ডপে কুড়কুড়ি, তাসার রমরমা।
পুজো ময়দানের খবর, গত কয়েক বছর ধরেই শহরের ছোট-বড়-মাঝারি পুজোয় থিম সং চালু হয়েছে। সেই সঙ্গীত তৈরিতে নেমে পড়েছেন গায়ক, সুরকার, তালবাদ্যশিল্পী, ব্যান্ডের তারকারা। কোথাও গান লিখছেন কবি-গীতিকার, কোথাও বা পুজোকর্তা। থিমের গান লেখায় রয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
গতবারের মতোই এ বারও মুখ্যমন্ত্রীর ভাবনায় থিম সাজিয়েছে নিউ আলিপুর সুরুচি সঙ্ঘ। থিমের গানও লেখা মুখ্যমন্ত্রীরই। গত বার লিখেছিলেন, ‘‘মাগো তুমি সর্বজনীন’’। এ বার লিখেছেন, ‘‘সব দেশই যে সবার দেশ/ তফাৎ শুধু নামে/ এই পৃথিবী একটাই দেশ/ ভ্রাতৃত্বের টানে।’’ এই গানে সুর দিয়েছেন টলিউডের সুরকার জিৎ গাঙ্গুলি। গত বার গেয়েছিলেন শ্রেয়া ঘোষাল, এ বার সুরুচির গান বলিউডের গায়িকা পালক মুচ্ছলের গলায়। থিম সং তৈরিতে পিছিয়ে নেই তৃণমূলের প্রাক্তন মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও। পাড়ার পুজো হিন্দুস্থান ক্লাবের জন্য গান লিখেছেন তিনি। গেয়েছেন রূপঙ্কর।
গত কয়েক বছর ধরে থিম সং তৈরির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন সুরকার জয় সরকারও। এ বার ৬৬ পল্লিতে পুরনো কলকাতার থিমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে থিম সঙ্গীত তৈরি করেছেন তিনি। তবে এ বার পুজোর গানে নতুন চমক কবীর সুমন। ঠাকুরপুকুর এস বি পার্ক সর্বজনীনের থিম সং তৈরি করেছেন তিনি। সেখানে শিল্পী ভবতোষ সুতার থিম হিসেবে বেছে নিয়েছেন কাঁধে নেওয়ার ‘বাঁক’। পুজো ময়দানের খবর, দুরুদুরু বুকে সুমনের কাছে প্রস্তাব পেড়েছিলেন ভবতোষ। বিফল মনোরথে ফিরে আসতে হয়নি তাঁকে।
কেউ কেউ আবার থিম সং তৈরির সঙ্গে মিলিয়ে দিচ্ছেন প্রতিমা তৈরির কায়দাও। কুমোরটুলিতে এক জন মৃৎশিল্পী যেমন একাধিক প্রতিমা তৈরির বরাত নেন, তেমনই গান-বাজারেও এক জন শিল্পী গুচ্ছ গুচ্ছ থিম সং তৈরি করছেন, এমন উদাহরণও বিরল নয়।
থিম মিউজিককে এ বার অবশ্য ভিন্ন ধাঁচে পেশ করছে হিন্দুস্থান পার্ক সর্বজনীন। সেখানে ঠাকুরমার গল্প বলাকে তুলে ধরতে সঙ্গীত নয়, থাকছে ভাষ্যপাঠ। গান বা সুরের মতো সেটাই বাজবে মণ্ডপে। ঠাকুরমার স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে ভাষ্যপাঠে শোনা যাবে প্রবীণ অভিনেত্রী চিত্রা সেনের কণ্ঠ।
তা হলে কি সত্যিই বদলে গেল বাঙালির পুজোর বাদ্যি?
অনেকেই বলছেন, বদল তো ঘটছেই। যে ভাবে পুজোর ধরন বদলেছে, যে ভাবে বদলেছে পুজোর পরিবেশ, তার সঙ্গে তাল মিলিয়েই বদলে গিয়েছে পুজোর বাদ্যির ধরন। সঙ্গীত জগতের সঙ্গে জড়িত অনেকেই মেনে নিচ্ছেন, এক সময়ে পুজোর গান নিয়ে যে মাতামাতি ছিল, এখন ইউটিউব-টরেন্ট-এমপি থ্রি-র যুগে সে সব নেহাতই ‘নস্টালজিয়া’। সেই জায়গায় নতুন দিক থিম সং।
বদলে যাচ্ছে ঢাকের শব্দও। এক সময়ে পালক লাগানো ঢাকের ছবিই ছিল পুজোর ‘সিম্বল’। কিন্তু শহরতলি তো বটেই, খাস মহানগরের বহু পুজোতেই এখন ঢাকের বদলে কুড়কুড়ি দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে সেই চেনা ‘বোল’। পুজোকর্তাদের অনেকেই বলছেন, ঢাকির খরচ যে ভাবে বাড়ছে, তা সামাল দিতেই কুড়কু়ড়ি নিয়ে আসা হয়। ‘‘ঢাক সামলে রাখাটাও ঝক্কির। সেখানে ছোট মাপের কুড়কুড়িতে নবীন প্রজন্মের ঢাকিরাও অনেক স্বচ্ছ্বন্দ,’’ বলছেন ওই পুজোকর্তা।
তবে এত কিছুর পরেও বাদ্যি যে একেবারই বদলে গিয়েছে, এমন কথায় সায় দিচ্ছেন না মহানগরের বেশিরভাগ পুজোকর্তাই। তাঁরা বলছেন, থিম পুজো যতই মাথাচাড়া দিক, সাবেক পুজো যেমন হারিয়ে যায়নি, তেমনই বাঙালির সাবেক ‘থিম সং’-ও কিন্তু এখনও ফিকে হয়নি।
আজ, শুক্রবার মহালয়া। দেবীপক্ষের শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ভোরে রেডিওতে বেজে উঠবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ। তার সঙ্গে সঙ্গে ‘জাগো দুর্গা’, ‘বাজল তোমার আলোর বেণু’। উত্তর কলকাতার এক থিম পুজোর কর্তা মেনে নিচ্ছেন, ‘‘ওই স্তোত্র এবং গানেই কিন্তু পুজোর আসল মেজাজ তৈরি হয়।’’
মহালয়ার ভোরে সেই সাবেক থিমেই উৎসব কাপে যাত্রা শুরু বাঙালির।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy