রুদ্ধ-পথ: পোদ্দার কোর্ট এলাকায় টেরিটিবাজারের গির্জার সামনে রাস্তা জুড়ে পার্কিংয়ের জঙ্গল। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক ।
একদা ‘গ্রে টাউন’ নামে খ্যাত ছিল ওই তল্লাট। ওয়্যারিংয়ের মাকড়শার জাল আর পার্কিংয়ের জঙ্গলের আড়ালে ইতিহাস কথা বলে এখনও। এ শহরের ‘চাইনিজ় ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’-এর কর্তা বিনি ল ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, “পোদ্দার কোর্টে টুং অন আর সি ইপ গির্জার সামনে থেকে ঝুপড়ি, জঞ্জাল এবং পার্কিংয়ের জটলাটা কি পুরসভা হটাতে পারে না? খুব বেশি কিছু কি চাইছি?”
চিনেপাড়ার সুদৃশ্য মন্দিরগুলি বিভিন্ন পর্যটন সফরের ক্ষেত্রে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কয়েকটির এখন বেশ জরাজীর্ণ অবস্থা। নানা পৃষ্ঠপোষকতা খুঁজে শহরের চিনারাই সেগুলি সারাচ্ছেন। টেরিটিবাজারের চিনা প্রাতরাশের উৎকর্ষেও ভাটার টান। বিনির কথায়, “চায়না টাউনের নানা ঐতিহ্যের পর্যটন-সম্ভাবনা নিয়ে কারও কোনও হেলদোল নেই। ট্যাংরার চায়না টাউনেও চলছে প্রোমোটারির বাড়বাড়ন্ত। সেখানকার নিজস্বতাও বিপন্ন!”
চিন থেকে বরিশাল হয়ে আট দশক আগে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন বিনির ঠাকুরদা। আইআইটি-র কৃতী ছাত্র বিনি আমেরিকায় চাকরি করতে গিয়েছিলেন। কলকাতাকে ছেড়ে থাকতে পারেননি। ঝকঝকে ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট, ৪৪ বছরের পার্সি যুবা রতন পোস্টওয়ালাও কলকাতা ছাড়া কোথাও থাকার কথা ভাবতে পারেন না! তাঁরও মত, মধ্য কলকাতার এই পার্কিং-জট আর পরিচ্ছন্নতার হাল আর একটু উন্নত হতে পারত!
বাস্তবিক, শহরের চোখ জুড়ানো ইহুদি সিনাগগ বা আর্মানি গির্জা ঘিরে আগ্রহ থাকলেও বড়বাজারের যানজট ঠেলে সেখানে পৌঁছনো রীতিমতো দুরূহ কাজ। বছর শেষের এই সময়টায় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অধ্যুষিত বো ব্যারাক বা চিনা ইটিং হাউসগুলিতে ঢুঁ মারতেও অনেকে মুখিয়ে থাকেন। কলুটোলা বা জ়াকারিয়া স্ট্রিটের সুখাদ্যের টানেও ভিড় জমে। ভাঙাচোরা, নোংরা, ভিড়ে ঠাসা গলির সাতরঙা সংস্কৃতিই অনেকের কাছে কলকাতার সব থেকে বড় পরিচয়। কলকাতা পুরসভার স্পেশ্যাল কমিশনার তাপস চৌধুরী এর গুরুত্ব মানছেন। তবে তাঁর কথায়, “এলাকা সাফসুতরো রাখতে পুরসভাও যথেষ্ট চেষ্টা করে। কিছু ক্ষেত্রে পথচারী বা সাধারণ বাসিন্দাদেরও দায়িত্ব থাকে।” বিদায়ী পুরবোর্ডের এক শীর্ষ কর্তা বলছেন, “কলকাতার বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে মেলে ধরা বা পর্যটনে গুরুত্ব দেওয়ার কথা আমরা ভোট-ইস্তাহারে বলেছি।”
গোয়ান খ্রিস্টান মারিয়া ফার্নান্ডেজ বা চায়না টাউনের ট্যানারি-মালিক জোসেফ চেনের মতো কেউ কেউ আবার শহরের রাজনীতির মূলস্রোতে আগ্রহী। ‘মমতাদির ভক্ত’ জোসেফ ট্যাংরায় পুরভোটের জন্য চিনা অক্ষরে দেওয়ালে লিখেছেন। তাঁর বক্তব্য, “চিনাদেরও অনেকের গুটিয়ে থাকা অভ্যাস। জল-কলের সমস্যা মেটাতে নিজেদেরও সক্রিয় হতে হবে।” রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্য মারিয়ার কথায়, “খ্রিস্টানদের মধ্যে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান থেকে গোয়ান, মালয়ালি, বাঙালি বা তামিল— কত জনই কলকাতায় রয়েছেন। পুরপ্রতিনিধিদের সহৃদয়তায় নিউ মার্কেট এলাকার গির্জা থেকে ঠাকুরপুকুরের সমাধিক্ষেত্রে নানা ভাল কাজ হয়েছে।” তবে কয়েকটি এলাকায় নাগরিক সমস্যার শিকার বিভিন্ন সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মানুষই। পিকনিক গার্ডেন থেকে খিদিরপুরের বস্তি অঞ্চলে নানা সমস্যা। তবে এখনও দেশের অনেক শহরের তুলনায় কলকাতা যে সকলের জন্য ঢের শান্তি ও সহিষ্ণুতার, এই বোধটাও আছে। কৃষি আন্দোলনে কলকাতার সমর্থনের নেতৃত্বে থাকা মনজিৎ সিংহ বিট্টাও এ শহর ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকার কথা ভাবতেই পারেন না।
বিভিন্ন ধর্ম বা ভাষাভাষী গোষ্ঠীর মধ্যে এখন সব থেকে ছোট দল কলকাতার ইহুদিরা। অতিমারিতে জনা পাঁচেক বৃদ্ধার মৃত্যুর পরে তাঁরা কমে এখন জনা
পনেরো। তাঁদের অভিযোগ, নিকাশি ব্যবস্থার গোলমালে নারকেলডাঙার ইহুদি সমাধিক্ষেত্রে জল ঢুকে সৌধগুলির ক্ষতি হচ্ছে। কেউ আবার বলছেন, শুধু পুর পরিষেবার দায় নয়, শহরের সংস্কৃতি রক্ষার কাজটাও মনে রাখা উচিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy