Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
KMC Election 2021

KMC Election 2021: অপ্রাপ্তি বহু, করোনায় ধ্বস্ত জীবন চাইছে উন্নয়নের ছোঁয়া 

আবুই শুধু নন, গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ এলাকায় বস্ত্র শিল্পের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ মানুষই এখন তীব্র অর্থকষ্টে রয়েছেন।

অব্যবস্থা: রাস্তায় জমে আবর্জনার স্তূপ। আক্রা রোডের এবিএম হাটের সামনে।

অব্যবস্থা: রাস্তায় জমে আবর্জনার স্তূপ। আক্রা রোডের এবিএম হাটের সামনে। নিজস্ব চিত্র।

কাজল গুপ্ত ও মেহবুব কাদের চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২১ ০৫:২৮
Share: Save:

‘‘করোনা আমাদের শুধু প্রাণে মারেনি, ভাতেও মেরেছে,’’ খানিকটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতেই কথাগুলো বলছিলেন আবু ইসমাইল।

আবুই শুধু নন, গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ এলাকায় বস্ত্র শিল্পের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ মানুষই এখন তীব্র অর্থকষ্টে রয়েছেন। করোনা কেড়ে নিয়েছে কাজ। খদ্দের প্রায় নেই বললেই চলে। লকডাউনের সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে সরবরাহ করা হয়েছিল খাবার এবং প্রয়োজনীয় নানা সামগ্রী। তাতে দিন গুজরান হলেও সমস্যা মেটেনি। বিচালিঘাটের কাছে এক দর্জি বললেন, ‘‘দানের খাবারে কত দিন বাঁচা যায় বলুন? স্থায়ী কাজ দরকার।’’ বস্ত্র শিল্পকে বাঁচাতে সরকারি সাহায্য, অনুদান ও বিনা শর্তে ঋণ চান গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ এলাকার ব্যবসায়ী ও কারিগরেরা।

তাঁরা জানালেন, করোনাকালের আগে আক্রা রোড বা বড়তলার মতো এলাকা রোজই সরগরম থাকত ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে। মইনুল হক নামে এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘করোনা সব শেষ করে দিয়ে গেল।’’ এখন ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু হলেও স্থানীয়দের দাবি, পরিকাঠামোর আমূল সংস্কার দরকার।

এ বিষয়ে ১৫ নম্বর বরোর বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর রঞ্জিত শীল বললেন, ‘‘নতুন পুরবোর্ড গঠিত হওয়ার পরে এলাকার দর্জিদের আর্থিক অবস্থা কী ভাবে বদলানো যায়, তা নিয়ে পুর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব।’’

শুধু বস্ত্র নয়, করোনার প্রভাব পড়েছে অন্যান্য শিল্পেও। জাহাজ ও যন্ত্রাংশ নির্মাণ শিল্পেও কাজ হারিয়েছেন বহু শ্রমিক। যাঁরা টিকে গিয়েছেন, তাঁরা অসন্তুষ্ট বেতন-বৈষম্য নিয়ে। যদিও শাসকদলের প্রতিনিধিরা বলছেন, সরকার শ্রমজীবীদের পাশে রয়েছে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।

১৯৮৪ সালে মেটিয়াবুরুজ ও গার্ডেনরিচ এলাকা কলকাতা পুরসভার অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু এত বছর পরেও উন্নয়নের খুব বেশি চিহ্ন চোখে পড়ে না সেখানে। একদা নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের তৈরি শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান মেটিয়াবুরুজ আজ সব দিক থেকেই অবহেলিত বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ। ১৫ নম্বর বরোর ন’টি ওয়ার্ডের মধ্যে তিনটিই কলকাতা বন্দর এলাকায় (১৩৩-১৩৫)। বাকি ছ’টি মেটিয়াবুরুজে (১৩৬-১৪১)। অধিকাংশ বাসিন্দাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। উর্দুভাষীদের পাশাপাশি রয়েছেন বাংলাভাষীরাও। বাঙালি মুসলিমদের অধিকাংশই যুক্ত রেডিমেড পোশাকের কারবারে।

তাঁদের অভিযোগ, এলাকায় পরিকাঠামোর বিশেষ উন্নতি হয়নি। রাস্তাগুলিরও বেহাল দশা। মেটিয়াবুরুজের প্রধান দু’টি রাস্তার মধ্যে এস এ ফারুকি রোড রামনগর থেকে আক্রা ফটক হয়ে সন্তোষপুর পর্যন্ত বিস্তৃত। অপরটি রেললাইন রোড, গাঁধী ময়দান থেকে গিয়েছে সন্তোষপুর পর্যন্ত। অভিযোগ, দু’টি রাস্তারই ঠিকমতো সংস্কার হয় না। অভিযোগ রয়েছে পাহাড়পুর রোড নিয়েও। বস্ত্র ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, ‘‘বড় রাস্তারই যদি এই হাল হয়, তা হলে বাকি রাস্তার কী দশা, বুঝতেই পারছেন।’’

পানীয় জল নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। সম্প্রতি পানীয় জলের দাবিতে রাস্তা অবরোধ করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অভিযোগ, পুরসভার লাইন থাকলেও জলের চাপ খুব কম। প্রায়ই ময়লা জল বেরোয়। এ বিষয়ে ১৪০ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর তথা তৃণমূল প্রার্থী আবু মহম্মদ তারিক বললেন, ‘‘আমার ওয়ার্ডে বুস্টার পাম্পিং স্টেশনের কাজ চলছে। কাজ শেষ হলেই সমস্যা মিটে যাবে।’’ ওই ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী রাজা মোল্লার আবার অভিযোগ, ‘‘তৃণমূল বহু বছর ধরে ওই বুস্টার পাম্পিং স্টেশনের কথা বলছে। আজও কিছু হয়নি।’’ ১৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী শামসুজ্জামান আনসারির দাবি, আগের চেয়ে জল সরবরাহের অনেক উন্নতি হয়েছে।

এলাকাবাসীর আর একটি আতঙ্কের বিষয় হল, রাস্তার জমা জল। যদিও ১৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী তথা বিদায়ী বরো কোঅর্ডিনেটর রঞ্জিতবাবুর দাবি, ‘‘নিকাশির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। নিচু এলাকায় আগে টানা কয়েক দিন জল জমে থাকত। এখন কয়েক ঘণ্টায় জল নেমে যায়।’’ ১৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী শুভাশিস পোদ্দারের অভিযোগ, ‘‘আমাদের কথা ছেড়েই দিন। খোদ তৃণমূলের লোকজনই নিকাশি নিয়ে অভিযোগ করছেন।’’ ১৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী মহম্মদ সেলিমের দাবি, জল জমার সমস্যা এতটুকুও কমেনি।

বাসিন্দাদের বক্তব্য, ওই এলাকার নিকাশি অনেকটাই নির্ভরশীল মণি খালের উপরে। সেই খালের সংস্কার হয় না বলেই নিকাশির উন্নতি হয় না। ১৪০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের অভিযোগ, সেখানকার বিধানের মাঠ, মালিবাগান, সাতঘড়া, খালধারি, পশ্চিম জলা ও বাগানি বিল্ডিং এলাকায় অল্প বৃষ্টিতেই জল জমে যায়। ১৪১ নম্বর ওয়ার্ডের আয়ুবনগর, ওয়ারিশনগর, উঁচামাঠ, নিচামাঠ, বদরতলা লেন ও লস্করপাড়ারও প্রায় একই অবস্থা।

সেই সূত্রেই উঠে এসেছে অবৈধ নির্মাণ নিয়ে অভিযোগও। ১৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী সদানন্দ প্রসাদের কথায়, ‘‘এখানে আইন মেনে নির্মাণ খুব কমই হয়।’’ যদিও অভিযোগ খারিজ করে শাসকদলের নেতা-কর্মীদের বক্তব্য, ‘‘এমন ভিত্তিহীন প্রচারে আখেরে কোনও লাভ হবে না।’’

ব্যবসা-কেন্দ্রিক এই বরো এলাকার একাধিক হাট ঘিরে তীব্র যানজট হয়। বড়তলা, জব্বার, জনতা-সহ বিভিন্ন হাটে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন। এলাকাবাসীর বক্তব্য, হাটের দিনে অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে যাওয়ারও উপায় থাকে না। স্থানীয় স্কুলশিক্ষক নাসরুল বারি বললেন, ‘‘যানজট নিয়ে প্রশাসনকে জানিয়েও লাভ হয়নি।’’ তিনি জানালেন, অধিকাংশ ফুটপাতই জবরদখলকারীদের কব্জায়। যেমন, এস এ ফারুকি রোডের কাচ্চি সড়ক থেকে বারিক মোল্লা গেট পর্যন্ত অংশে ফুটপাত গিয়েছে ‘চুরি’ হয়ে। যদিও এই অভিযোগ পুরোপুরি মানতে নারাজ তৃণমূল প্রার্থীরা। তাঁরা আবার নিজেদের প্রচারে সাফল্যের খতিয়ান হিসাবে পুর স্কুলের পরিকাঠামোর উন্নয়ন, রাস্তার আলোকায়ন, এলাকার সৌন্দর্যায়ন এবং জল, নিকাশি, রাস্তাঘাট ও স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতির কথা বলছেন।

মেটিয়াবুরুজের বাসিন্দা, অধ্যাপক মহম্মদ ওয়ারিশের আবার অভিযোগ, ‘‘এলাকায় স্কুল-কলেজের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।’’ তা সত্ত্বেও ১৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের বটতলা মোড়ে মেটিয়াবুরুজ গার্লস হাইস্কুলটি বন্ধ হয়ে রয়েছে। সংস্কারের কাজের জন্য প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে মহেশতলার পাঁচুড় কলেজে স্থানান্তরিত হয়েছে সেই স্কুল। এ কারণে অনেকে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে।

স্বাস্থ্য নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। ১৪১ নম্বর ওয়ার্ডে মেটিয়াবুরুজ স্টেট জেনারেল হাসপাতাল সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে রূপান্তরিত হলেও বিভিন্ন বিভাগে চিকিৎসকের অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ। ওই ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী শিবনাথ গায়েন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপকের চাকরি ছেড়ে পুরভোটে লড়ছেন। তাঁর আশ্বাস, ‘‘ওই হাসপাতালের উন্নয়নে সচেষ্ট হব।’’

১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে পুরসভা পরিচালিত গার্ডেনরিচ মাতৃসদনের অবস্থাও সঙ্গিন। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ওটি থাকলেও গত দু’বছরে কোনও সিজ়ার হয়নি। আল্ট্রাসোনোগ্রাফি যন্ত্র দীর্ঘ দিন ধরে পড়ে থাকলেও ব্যবহার হয় না। প্রসূতিদের অবস্থা সামান্য বেগতিক দেখলেই ‘রেফার’ করে দেওয়া হয় অন্য হাসপাতালে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

KMC Election 2021 Gardenreach
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE