Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
KMC Election 2021

KMC Election 2021: উধাও হয়েছে জলাভূমি, যন্ত্রণা বাড়াচ্ছে জল ‘চুরি’

ইএম বাইপাস থেকে কয়েক কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে এই বরোর গুলশন কলোনিতে এলে আবার মনেই হবে না, সেটি আদতে কলকাতা পুরসভার অধীন!

বেহাল: নোনাডাঙা এলাকার রাস্তায় জমা জলে ভাসছে প্লাস্টিক ও আবর্জনা।

বেহাল: নোনাডাঙা এলাকার রাস্তায় জমা জলে ভাসছে প্লাস্টিক ও আবর্জনা। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

আর্যভট্ট খান ও চন্দন বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:২২
Share: Save:

কোথাও খাল ৪০ ফুট চওড়া, কোথাও সেই প্রস্থ কমে দাঁড়িয়েছে ২৫ ফুটে, কোথাও আবার আরও কম। সেই সঙ্গে দু’পারে ঘন জনবসতি। যেখানে বসতি যত বেড়েছে, সেখানে ততই কমেছে খালের প্রস্থ। বর্ষায় খালের জল দু’কূল ছাপিয়ে বসতিতে ঢোকে তো বটেই, রেহাই পায় না আশপাশের এলাকাও। ১২ নম্বর বরোর এই নোনাডাঙা খালই যেন এলাকার মানুষের গলার কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে।

খাল সংলগ্ন ভিআইপি নগর এলাকার এক চা-দোকানি বলছিলেন, ‘‘কেন গলার কাঁটা হবে না বলুন তো? কোনও দিনই তো এই খাল সংস্কার হয় না। তার উপরে রয়েছে জবরদখল। আশপাশের বাড়ির যত আবর্জনা, সব পড়ে খালের জলে। একটু বেশি বৃষ্টি হলেই খালের নোংরা জল উঠে আসে বাড়ি ও দোকানের মধ্যে। বছরের পর
বছর এ ভাবেই চলছে।’’

চলতি বছরের বর্ষাতেও একাধিক বার নোনাডাঙার জলে ডুবেছে ভিআইপি নগর, চৌবাগা, আনন্দপুরের কিছু এলাকা। স্থানীয়দের অভিযোগ, জল নামতে কখনও সময় লাগে এক দিন, কখনও তারও বেশি। গোটা বর্ষায় এই জল-যন্ত্রণা সয়েছেন এলাকার মানুষ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পানীয় জলের সমস্যা। যে সমস্যা অন্যতম মাথাব্যথা ১২ নম্বর বরোর ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডের বানতলা এলাকাতেও।

ইএম বাইপাস থেকে কয়েক কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে এই বরোর গুলশন কলোনিতে এলে আবার মনেই হবে না, সেটি আদতে কলকাতা পুরসভার অধীন! ভাঙাচোরা রাস্তা, আবর্জনা, পানীয় জলের কল থেকে সরু সুতোর মতো জল পড়া— সবই যেন পুর পরিষেবায় খামতির সাক্ষ্য বহন করছে। তিতিবিরক্ত এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘কত আর বলব! পাওনা বলতে তো শুধু ভূরি ভূরি প্রতিশ্রুতি। বছর বছর শাসক এবং বিরোধী, সব দলের মিছিল এসে পৌঁছলেও এলাকায় উন্নয়ন পৌঁছয় না।’’

১২ নম্বর বরোর এক দিকে বাঘা যতীন মোড়, অন্য দিকে রাজডাঙা, মুকুন্দপুর, পূর্বালোক, নয়াবাদ, পঞ্চসায়র, শহিদ স্মৃতি কলোনি, অভিষিক্তার মতো এলাকা। এক দিকে আকাশছোঁয়া বহুতল, আর এক দিকে খালের দু’পারে দখলের চিত্র প্রকট এই বরোয়। এলাকা ঘুরে দেখা গেল, সিংহভাগ বাসিন্দা আঙুল তুলছেন জল জমার সমস্যার দিকে। জল না-নামার খলনায়ক হিসাবে উঠে আসছে খালগুলির সংস্কার না হওয়া। পূর্বালোকের বাসিন্দা অমিয় পাত্র বললেন, ‘‘এই এলাকাকে বলা হত পূর্ব কলকাতা জলাভূমি। সেই জলাভূমি আর কোথায়? বরং, একের পর এক জলাভূমি উধাও হয়ে যেতে দেখলাম। একটি পাম্পিং স্টেশন পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে জলাভূমির উপরে। পরিবেশকে তছনছ করে চলছে একের পর এক নির্মাণ। প্রতিবাদ করার কেউ নেই।’’ আর এক বাসিন্দা অরূপ দাস বলেন, ‘‘বাম আমলে শুরু হয়েছিল প্রকৃতি নষ্ট করে নগরায়ণ। ভেবেছিলাম, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে নগরায়ণ ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য থাকবে। কিন্তু কোথায় কী?’’

শুধু জল জমাই নয়, ১২ নম্বর বরোর বিস্তীর্ণ এলাকায় রয়েছে পানীয় জলের সমস্যাও। বিশেষত ১০১, ১০২, ১০৭ ও ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডে এই সমস্যা বেশি। স্থানীয়দের অভিযোগ, ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের রবীন্দ্রপল্লি, বীরনগর, কেন্দুয়ার একাংশে আগে তিন বেলা পুরসভার জল এলেও এখন অধিকাংশ সময়ে তা মেলে না। রবীন্দ্রপল্লির বাসিন্দা ধীরেন বিশ্বাসের কথায়, ‘‘মিষ্টি জল আসা তো বন্ধই হয়ে গিয়েছে। যেটুকু জল আসে, তা-ও এত সরু হয়ে পড়ে যে ফ্ল্যাটের দোতলায় জল তোলা যায় না।’’ আরও অভিযোগ, পরিস্রুত জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ জল। জায়গায় জায়গায় পানীয় জলের পাইপ ফেটে জল বেরিয়ে যাচ্ছে। যার সুযোগ নিচ্ছে ‘জল মাফিয়ারা’। অভিযোগ, পাইপ ফুটো করে জল বার করে চড়া দামে বিক্রি করছে তারা। এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘জল মাফিয়ারা বিভিন্ন জায়গায় পাইপ ফুটো করে জল নিয়ে নিচ্ছে। কলে সরু হয়ে জল পড়ার এটাও একটা কারণ। পুর প্রতিনিধিরা কি কিছুই দেখেন না? আর কত দিন এই যন্ত্রণা সইতে হবে?’’

পুর পরিষেবায় খামতির ছবি উঠে এসেছে ১০২, ১০৫, ১০৬, ১০৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকেও। জল জমা থেকে বেহাল রাস্তা— তালিকা দীর্ঘ। ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডের সন্তোষপুর, হাতিবাড়ি, দাসপাড়া এলাকায় পানীয় জলের সমস্যা না থাকলেও জল জমার অভিযোগ করছেন স্থানীয়েরা। আছে রাস্তা সমান করার নামে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও। ১০২ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর, বিজেপির রিঙ্কু নস্কর বললেন, ‘‘নিকাশির সমস্যা অনেকটাই মেটানো হয়েছে। তবে পুর বোর্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে গত কয়েক মাসে কোনও কাজ করতে দেওয়া হয়নি।’’

বাসিন্দাদের মতে, জল-যন্ত্রণার একটি কারণ যদি হয় খাল সংস্কার না হওয়া, অন্য পিঠে রয়েছে একের পর এক জলাভূমি ভরাট করে বহুতল নির্মাণ। অভিযোগ, এই কাজে মদত রয়েছে স্থানীয় ‘দাদাদের’। বহুতল তৈরির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে প্রোমোটিং থেকে সিন্ডিকেট-রাজ। যার বাড়বাড়ন্ত মূলত কসবা, রাজডাঙা থেকে শুরু করে বাইপাসের দু’ধারে। মুকুন্দপুরের এক বাসিন্দা বললেন, ‘‘অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয় না। আর কার কাছেই বা অভিযোগ জানাব? তাই সব মেনে নিয়ে মুখ বুজে থাকতে হয়।’’ কসবা রাজডাঙার বাসিন্দারা আবার জানালেন, এলাকার ফাঁকা জমিগুলি তাঁদের মাথাব্যথা। সেখানে আবর্জনার স্তূপে বংশবৃদ্ধি করছে মশা।

১২ নম্বর বরোর বিদায়ী চেয়ারম্যান সুশান্তকুমার ঘোষ বললেন, ‘‘এটা ঠিক যে, এলাকায় জল জমার সমস্যা রয়েছে। জলাভূমি বুজিয়ে শুধু আবাসন তৈরিই নয়, এখানে অনেক সেতুও তৈরি হয়েছে। চলছে মেট্রো রেলের কাজ। সব মিলিয়ে খালগুলি নাব্যতা হারিয়েছে। ফলে আগে যত তাড়াতাড়ি জল নামত, এখন তা নামতে সময় লাগছে। তবে পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে বুস্টার পাম্পিং স্টেশন তৈরি হচ্ছে। এলাকাবাসীকে খুব বেশি দিন আর কষ্ট ভোগ করতে হবে না।’’ প্রোমোটিং বা সিন্ডিকেট-রাজ নিয়ে সুশান্তবাবু মন্তব্য করতে না চাইলেও জল-মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ পরোক্ষে মেনে নিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘জল-মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য আগের চেয়ে কমেছে। অনেককে পুলিশ গ্রেফতারও করেছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

KMC Election 2021 WAter log Drinking Water Crisis
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE