এ বছরের গোড়াতেই বাঙালিরা ক্যালেন্ডারে দাগিয়ে রেখেছিল পয়লা বৈশাখ, শনিবার। সামনের রবিবার তো ছিলই, সেই সঙ্গে পিছনের ‘গুড ফ্রাইডে’ জুড়ে নিয়ে লম্বা সপ্তাহান্তে শহরের বাইরে পা বাড়িয়েছেন অনেকে। দিঘা-পুরী-দার্জিলিঙের হোটেলগুলি সে কথাই বলছে। আর যাঁরা রয়ে গিয়েছেন শহরে, তাঁরা পুরোদস্তুর বাঙালিয়ানায় মুড়েই শুরু করলেন নতুন বছর।
এ বছর শহর জুড়ে বাংলাদেশের মতো করে বহু সমারোহে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উৎসবে মেতেছিলেন বহু বাঙালি। নববর্ষের সকালে গাঙ্গুলিবাগান থেকে যাদবপুর পর্যন্ত মঙ্গল শোভাযাত্রায় ছিল পথজোড়া আল্পনা, রণপা, ছৌ-মুখোশ, পট-সহ বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির বিবিধ নিদর্শন। শোভাযাত্রার অন্যতম উদ্যোক্তা বুদ্ধদেব ঘোষ জানালেন, বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রার অনুপ্রেরণাতেই এই আয়োজন, যার অন্যতম বার্তাই হল সম্প্রীতি।
সম্প্রীতির বার্তা দিতে আরও একটি শোভাযাত্রা বেরোয় দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারী এলাকায়। নানা রকম সুসজ্জিত ট্যাবলোয় ছিল সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের প্রতীক। স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ওই শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের গান গেয়ে এলাকা প্রদক্ষিণ করেন স্কুলপড়ুয়া ও বিশিষ্টজনেরা।
এ দিন সকাল থেকে কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর ও লেক কালীবাড়ি মন্দিরে পা ফেলার জায়গা ছিল না। কাঠফাটা রোদে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে পুজো সেরে দোকানে এসে নতুন খাতা খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। শুক্রবার গভীর রাতে কালীঘাট মন্দিরে গিয়ে পুজো দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ফুল-মিষ্টির গন্ধে ম ম বইপাড়ায় ঘুরে বেরিয়েছে বই-পাগলের দলও। এর মধ্যেই চিরন্তন শাড়ি-পাঞ্জাবির ‘একলা’ হওয়ার চেষ্টা চোখে পড়ল ময়দান, প্রিন্সেপ ঘাট, মিলেনিয়াম পার্কে। দল বাঁধা উচ্ছ্বাসে, নতুন জামা-নিজস্বী-আইসক্রিমের মেলবন্ধনে নতুন বছরের প্রথম দিনটা উদ্যাপন করল এই প্রজন্ম। দিনভর সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরল বাংলা ভাষার শুভেচ্ছা। এর মধ্যেই আইপিএল-এর ম্যাচ ঘিরে ইডেন গার্ডেন্সের আশপাশে ভিড় জমাল ক্রিকেট-পাগল বাঙালি, যেখানে রোজকার টি-শার্টের থেকে পাটভাঙা পাঞ্জাবির ভিড়ই চোখে পড়ার মতো বেশি।
বিকেলে কলেজ স্কোয়্যারে আয়োজিত হয় বাংলা নববর্ষের ‘জুলুস’। অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তা অভিজিৎ নন্দী বলেন, ‘‘সম্প্রীতির ডাকেই এই আয়োজন।’’ নববর্ষ উপলক্ষে কসবায় আয়োজিত হয়েছে দু’দিন ব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একই ভাবে নববর্ষকে বরণ করে নিতে নজরুলতীর্থে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন নিউ টাউন বইমেলা কর্তৃপক্ষ।
বাংলা ক্যালেন্ডার আর গোলাপ ফুল দিয়ে নববর্ষের উৎসবে মাতল উল্টোডাঙার ১৩ নম্বর ওয়ার্ড। স্থানীয় স্কুলের পড়ুয়া, শিক্ষক, চিকিৎসক-সহ বাসিন্দাদের নিয়ে শোভাযাত্রা বেরোয়। নেতৃত্ব দেন স্থানীয় কাউন্সিলর তথা বরো চেয়ারম্যান অনিন্দ্যকিশোর রাউত। অনুষ্ঠানে সামিল হয় কচিকাঁচা থেকে বয়স্করাও।
নববর্ষ উপলক্ষে মহাকরণ সংলগ্ন লালদিঘির পাড়ে এ দিন থেকে শুরু হল সপ্তাহান্তের বিনোদন এবং খাদ্যমেলা ‘দেখো রে’। এখন থেকে প্রতি শনি-রবিবার নানা রকম খাবারের দোকান এবং গান-বাজনা সহযোগে জমজমাট থাকবে লালদিঘির পাড়। দু’দিন আগেই বহরমপুর থেকে রিমোটের বোতাম টিপে তাঁর এই স্বপ্ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন নববর্ষের বিকেলে সেখানে যান মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়।
বাঙালির নববর্ষ অসম্পূর্ণ থেকে যায় পেটপুজো ছাড়া। গোলপার্কের কাছে একটি বাঙালি রেস্তোরাঁয় শনি-রবি দু’দিনের জন্য আয়োজিত হয়েছিল পাত পেড়ে ভূরিভোজ। ৬৪৯ টাকার বিনিময়ে জিভে জল আনা বিভিন্ন বাঙালি রান্নার যে কোনও পদ যতটা ইচ্ছে খাওয়া যাবে। মধ্য কলকাতার একটি বাঙালি চেনের রেস্তোরাঁয় গিয়েও দেখা গেল, ভিড় উপচে পড়ছে গেটের বাইরে পর্যন্ত।
সব মিলিয়ে বাংলার ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়েই আজকের গোটা দিন কাটিয়ে দিল বাঙালি। তবে জানা যায়নি, বাড়ির পোষা কুকুরটির সঙ্গেও এ দিন তাঁরা বাংলায় কথা বলেছেন কি না।