Advertisement
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩

‘বাবারা একটু খেয়ে গেলে না? পাপ দেবে ঠাকুর!’

বেশ খানিকক্ষণ ডাকাডাকির পর আড়মোড়া ভেঙে দরজা খুললেন বৃদ্ধার নাতনি বছর কুড়ির রিঙ্কু মিস্ত্রি। বললেন, ‘‘দিদার মাথার গন্ডগোল। মাঝে মধ্যেই বাড়ি ছেড়ে চলে যান।’’ কোথায় যান? ‘‘মামার কাছে।’’ রিঙ্কু জানান, তিনি ভেবেছিলেন এ দিনও মামার কাছেই গিয়েছিলেন দিদা।

অসহায়: বাঘা যতীন স্টেশনে সুনীতি হালদার।

অসহায়: বাঘা যতীন স্টেশনে সুনীতি হালদার।

স্যমন্তক ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৮ ০২:৪৭
Share: Save:

সোনারপুর সুভাষপল্লি। খালপাড়ে দু’কামরার ছোট্ট বাড়ি। চিলতে বারান্দায় ঠাকুরের আসনে গোপাল আর মেরির কোলে যিশুর সহাবস্থান। আর সেই ঠাকুরের আসনের পাশেই স্বপাক রান্নার সামান্য আয়োজন। ‘‘প্রথমে একটু চা করি? ভাতও আছে। দু’গ্রাস খেয়ে যেও কিন্তু বাবারা! এত রাত হল!’’ ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে দু’টো ছুঁয়েছে।

সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধার নাম সুনীতি হালদার। খানিক আগেও বাঘা যতীন স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে বসে হাউহাউ করে কাঁদছিলেন। কান্নার রোলে কেবল একটাই কথা বলছিলেন— ‘‘ছেলেটাকে মেরেই ফেলবে ওরা। আমায় একটু নিয়ে চল না বাবুর কাছে!’’

স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, শুক্রবার বিকেল থেকেই স্টেশন লাগোয়া এঁদো ফুটপাথে বসেছিলেন এই অশীতিপর বৃদ্ধা। স্থানীয় মানুষেরাই প্রথমে তাঁকে জল আর সামান্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে দেন। রাতের দিকে পৌঁছয় পাটুলি থানার পুলিশ। তারাই খবর দেয় যাদবপুর জিআরপি’কে। রাত ১১টা নাগাদ পৌঁছয় রেল পুলিশ। ততক্ষণে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মী প্রান্তিক চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর দলবলও। ঘর হারানো বয়স্ক মানুষদের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করাই তাঁদের কাজ। সকলের উদ্যোগে রাত প্রায় ১২টা নাগাদ রেল পুলিশের গাড়িতে বৃদ্ধাকে বাড়ি ফেরানোর তোড়জোড় শুরু হয়। বৃদ্ধা অবশ্য তখনও যেতে নারাজ। কেবলই বলে চলেছেন, ছেলে আসবেন। ছেলেই তো তাঁকে রেখে গিয়েছেন বাঘাযতীন স্টেশনে। নিতে আসবেনই।

শুক্রবার রাতে মেয়ের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার পরে

সোনারপুর থানা ঘুরে জিআরপি’র গাড়ি পৌঁছল খালপাড়ে। সঙ্গী প্রান্তিক এবং তাঁর বন্ধুরা। খালের ধারে পৌঁছে বোঝা গেল গাড়ি আর ঢুকবে না। শুরু হল মেঠো পথ ধরে হাঁটা। বৃদ্ধাই চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন মেয়ের বাড়ি। তাঁরই জমিতে তৈরি বাড়িতে থাকেন মেয়ে আর নাতনি। মিনিট কুড়ি হাঁটার পরে পৌঁছনো গেল দু’কামরার ছোট্ট বাড়িতে। এক ঘরে থাকেন মেয়ে আর নাতনি, অন্য ঘরে বৃদ্ধা। বেশ খানিকক্ষণ ডাকাডাকির পর আড়মোড়া ভেঙে দরজা খুললেন বৃদ্ধার নাতনি বছর কুড়ির রিঙ্কু মিস্ত্রি। বললেন, ‘‘দিদার মাথার গন্ডগোল। মাঝে মধ্যেই বাড়ি ছেড়ে চলে যান।’’ কোথায় যান? ‘‘মামার কাছে।’’ রিঙ্কু জানান, তিনি ভেবেছিলেন এ দিনও মামার কাছেই গিয়েছিলেন দিদা। রিঙ্কুর মা অবশ্য বাড়ি ছিলেন না। কোনও এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছেন বলে রিঙ্কুর দাবি। ‘‘আমাদের সঙ্গেই থাকে। কিন্তু দিদা কেবলই মামাদের কাছে যেতে চায়।’’ রিঙ্কু জানান, দাদুও মারা গিয়েছেন, কিন্তু দিদা সেটা মানতে চান না। তাই এখনও সিঁদুর পরেন।

বৃদ্ধা তখনও বলে যাচ্ছেন, ছেলে তাঁকে বাঘা যতীন স্টেশনে নিতে যাবেন। আর একটু অপেক্ষা করা দরকার ছিল। সত্যিই কি ছেলে ফেলে রেখে গিয়েছিলেন তাঁকে বাঘাযতীন স্টেশনে? উত্তর দিতে পারলেন না রিঙ্কু। দিতে পারলেন না মামার ফোন নম্বরও।

মাঝরাতে সোনারপুর সুভাষপল্লি খালপাড়ের মেঠো পথ ধরে ফেরার সময় দরজায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেন বৃদ্ধা। ‘‘বাবারা একটু খেয়ে গেলে না? পাপ দেবে ঠাকুর।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement

Share this article

CLOSE