কাউকে বাড়িতে ঢুকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, কাউকে সরাসরি খুনের। আপত্তিকর মন্তব্যের সঙ্গে বাদ যাচ্ছে না বাড়ির মেয়েকে অ্যাসিড ছোড়ার কিংবা গোটা পরিবারকে শেষ করে দেওয়ার হুমকিও। সীমান্ত-সংঘর্ষের এই পরিস্থিতিতে সমাজমাধ্যমে চলতে থাকা এমন ঘৃণাভাষ্য এই মুহূর্তে অন্যতম চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পুলিশের কাছে।
সূত্রের খবর, পহেলগামে পর্যটকদের উপরে হামলার পর থেকে গত ১৫ দিনে শুধুমাত্র কলকাতা পুলিশ এলাকাতেই এমন হুমকি এবং ঘৃণাভাষ্য ঘিরে অভিযোগ দায়ের হয়েছে সাড়ে তিনশোর বেশি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মামলা রুজু করে পুলিশ তদন্তে নামলেও বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত গ্রেফতারির কোনও খবর নেই। তাই প্রশ্ন উঠছে, মামলা রুজু হলেও কড়া শাস্তির ব্যবস্থা হচ্ছে না বলেই কি এমন প্রবণতা চলছে?
পুলিশ সূত্রে জানা যাচ্ছে, সাড়ে তিনশো অভিযোগের মধ্যে সব চেয়ে বেশি জমা পড়েছে ধর্ষণের হুমকির অভিযোগ। এর পরেই রয়েছে অ্যাসিড ছুড়ে বা অন্য ভাবে ক্ষতি করার হুমকি। খুনের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ জমা পড়েছে ৬০টি। বাড়িছাড়া করার বা পুরো পরিবারকে শেষ করে দেওয়ার হুমকির অভিযোগ জমা পড়েছে ৪০টি। পুলিশ
সূত্রের খবর, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগ এসেছে মহিলাদের তরফে। অনেকেই জানিয়েছেন, এমন হুমকির পর থেকে তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
পুলিশেরই দাবি, সাধারণত নির্বাচনের সময়ে এমন হুমকির অভিযোগ জমা পড়ার সংখ্যা বাড়ে। এর আগে উল্লেখযোগ্য ভাবে এমন অভিযোগ জমা পড়ার ঘটনা বেড়েছিল করোনার সময়ে। আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসক-পড়ুয়াকে খুন ও ধর্ষণের ঘটনার পরেও এমন বেশ কিছু অভিযোগ পেয়েছিল পুলিশ। কিন্তু, অতীতের এই সব কিছুকেই বর্তমান পরিস্থিতি ছাপিয়ে গিয়েছে বলে পুলিশের দাবি।
লালবাজারের যুগ্ম-নগরপাল পদমর্যাদার এক কর্তা বলছেন, ‘‘অনেকেই এমন হুমকির জেরে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন। বিরুদ্ধ মত শুনলেই ছবি অদলবদল করে ছড়িয়ে দেওয়া বা সামাজিক ভাবে বদনাম করতে যা যা করা সম্ভব, সব করতে দেখা যাচ্ছে।’’
সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ের আইনজীবী বিভাস চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, এমন ক্ষেত্রে হিংসা ছড়ানোর অভিপ্রায়ে উস্কানি দেওয়া, বিভিন্ন ধর্মীয়, জাতিগত, ভাষাগত সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা বাধানোর চেষ্টা, অন্যের সম্পর্কে মানহানিকর মন্তব্য, মহিলাদের সম্মানহানির অভিপ্রায় এবং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের ধারা যুক্ত করে পুলিশ মামলা করতে পারে। ‘তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ২০২১’-ও ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। তবে কী ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তার উপরে নির্ভর করে শাস্তির মাত্রা। অপরাধ প্রমাণিত হলে ন্যূনতম তিন বছর বা তার
বেশি কারাদণ্ড হতে পারে। বিভাস বলেন, “আদালতের নির্দেশ মেনে এমন ক্ষেত্রে এগোতে হয়। মামলা
রুজু হলেও গ্রেফতারি সহজ হয় না। ফলে অনেকেই ধরে নেন, সমাজমাধ্যমে যা খুশি বলে পার পেয়ে যাওয়া যায়।’’
মনোরোগ চিকিৎসক দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘কারও সঙ্গে মতের অমিল হওয়া মানেই যে তিনি আমার মতের বিরুদ্ধে নন, এই বোধটাই হারিয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সবজান্তা প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় যে কোনও ভাবে অন্যের সমাজিক সম্মান নষ্ট করা হচ্ছে। যিনি এমন করছেন এবং যাঁর উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে, এই পরিস্থিতি দু’জনের জন্যই ক্ষতিকর। এমন চলতে থাকলে মানুষ দ্রুত নিজের মতামত ব্যক্ত করাই বন্ধ
করে দেবে।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)