মূল অভিযুক্ত প্রীতম দেব
লাঞ্ছনার পারদটা ক্রমেই চড়ছিল।
প্রথমে কটূক্তি, কুপ্রস্তাব। রাস্তায় দেখা হলেই অভব্য আচরণ। তার পর প্রকাশ্য রাস্তায় গায়ে হাত দেওয়া, জোর করে চুম্বন। প্রতিবাদ করলে আরও বড় ক্ষতি করে দেওয়ার হুমকি। সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ছেলের মায়ের কাছে গিয়েছিল মেয়েটি। কিন্তু সন্তানসম মেয়েটির দিকে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেননি সেই মহিলা। উল্টে প্রকাশ্য রাস্তায় তাকে ঠেঙানোর ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। সে দিনের সেই নিগ্রহের পরে একদম চুপচাপ হয়ে যায় বছর কুড়ির ওই তরুণী। পরের দিন ভোরে তেতলার ছাদ থেকে দগ্ধ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। পুলিশের কাছে মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে সে জানিয়েছে, ক্রমাগত এই লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথটাই বেছে নিতে হয়েছে তাকে।
বরাহনগরের এই ঘটনা উস্কে দিয়েছে বছর দু’য়েক আগের মধ্যমগ্রামের ভয়াবহ কাণ্ডের স্মৃতি।
২০১৩-এর অক্টোবরে মধ্যমগ্রামে ধর্ষিত হয়েছিল এক কিশোরী। প্রথম বার ধর্ষিত হওয়ার পরে থানায় অভিযোগ দায়ের করে সে। পুলিশের কাছে অভিযোগ করার ‘অপরাধ’-এ তাকে দ্বিতীয় বার গণধর্ষিতা হতে হয়। এখানেই নির্যাতন শেষ হয়নি। পরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয় আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে মেয়েটি পুলিশকে জানায়, সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেনি। তার গায়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
বরাহনগরে অবশ্য টানা লাঞ্ছনা ও ও অভব্য আচরণই মেয়েটিকে ঠেলে দিয়েছিল আত্মহননের দিকে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মেয়েটির বাড়ির পাশেই থাকত প্রীতম দেব। তারই সমবয়সী। অভিযোগ, কয়েক মাস ধরে রাস্তাঘাটে মেয়েটির সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করত এবং কুপ্রস্তাব দিত যুবকটি। বাড়িতে কাউকে বললে প্রাণে মেরে দেওয়ার হুমকিও দিত সে। তরুণীর পরিবারের অভিযোগ, ভয়ে প্রথমে সে কাউকে কিছু জানায়নি। কিন্তু যুবকের অভব্য আচরণ ক্রমেই বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত বাড়িতে বিষয়টি জানায় মেয়েটি। তরুণীর পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, সে নিজেই প্রীতমের বাড়ি গিয়ে তার মাকে সব বলে। কিন্তু উল্টে তাকেই অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রীতমের মা অর্চনা দেব।
সেই ঘটনার পরে নাকি দুই পরিবার নিজেদের মধ্যে বিষয়টি মিটমাট করে নিয়েছিল। কিন্তু কয়েক দিন চুপ থাকলেও ফের তরুণীকে বিরক্ত করতে শুরু করে প্রীতম। তরুণীর এক আত্মীয়ের কথায়, ‘‘ছেলেটার ভয়ে কোনও জায়গায় বেরোতে পারত না মেয়েটা।’’
ওই তরুণীর বান্ধবীরাও বলছেন, ‘‘কাউকে কিছু বললেই ওর দাদাদের ক্ষতি করা হবে বলে হুমকি দিত ছেলেটি। তাই বাড়িতে কিছু বলতেও সাহস পেত না ও।’’ তরুণীর পরিবার পুলিশকে জানিয়েছে, দিনের পর দিন প্রকাশ্য রাস্তায় ওই তরুণীর সঙ্গে অশালীন আচরণ করত প্রীতম। তাকে জোর করে চুম্বনও করে বলে অভিযোগ। ফের প্রীতমের মাকে বলা হলে এ বার তিনি ওই তরুণীকে মারধর করেন। গত শুক্রবার অর্চনাদেবীর ঘনিষ্ঠ আরও কয়েক জন পুরুষ ও মহিলা রাস্তার মধ্যেই ওই তরুণীকে ফেলে মারতে শুরু করে।
তরুণীর দাদা পুলিশকে বলেছেন, ‘‘বোনের পোশাকও ছিঁড়ে দেওয়া হয়। সে দিন বাড়িতে ফিরে আসার পর থেকেই খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল ও। আমরা ভেবেছিলাম, পর দিন, শনিবার সকাল হলেই বিষয়টা পুলিশকে জানাব।’’
কিন্তু তার আর সুযোগ পেলেন না তরুণীর দাদা। পরের দিন ভোরবেলাতেই তেতলার ছাদে দগ্ধ অবস্থায় বোনকে খুঁজে পান তাঁরা। প্রথমে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় আর জি কর হাসপাতালে। পরে নীলরতন সরকার হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। শনিবার বিকেলে হাসপাতালে গিয়ে পুলিশ তরুণীর বয়ান নথিভুক্ত করে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, মেয়েটি মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে পুরো ঘটনাটি জানিয়ে গিয়েছে। রবিবার সকালে মারা যায় নিগৃহীতা।
শনিবার সকাল থেকেই এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে প্রীতম। চম্পট দিয়েছেন তার মা-ও। তরুণীর মৃত্যুকালীন জবানবন্দি ও তার পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে রবিবার পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতদের নাম, রানা রায় ওরফে বুড়ো, শুক্লা কর, শিবানী রায়, কমল কর ও পম্পা সরকার। তাদের বিরুদ্ধে মেয়েটিকে লাঞ্ছনার অভিযোগ রয়েছে। মূল দুই অভিযুক্ত মা ও ছেলে-সহ আরও কয়েক জনের খোঁজ চলছে। রবিবার সকালে তরুণীর মৃত্যুর খবর এলাকায় এসে পৌঁছতেই বিক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয় বাসিন্দারা। বিকেলে মৃতদেহ আসতেই তা আটকে রেখে অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন তাঁরা। পরে পুলিশ ও স্থানীয় কাউন্সিলরের হস্তক্ষেপে মৃতদেহ সৎকারে পাঠানো হয়। স্থানীয় কাউন্সিলর অঞ্জন পাল বলেন, ‘‘খুবই নিন্দনীয় ঘটনা। আগে জানলে নিশ্চয় কোনও ব্যবস্থা নিতাম। পুলিশকে বলেছি, সব অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে হবে।’’ ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার নীরজ সিংহ বলেন, ‘‘মেয়েটির জবানবন্দিই আমাদের কাছে বড় প্রমাণ। কয়েক জন ধরা পড়েছে। বাকিদেরও ছাড়া হবে না।’’
এ দিন ওই তরুণীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বাবা শয্যাশায়ী। তরুণীর এক বান্ধবী বলেন, ‘‘ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। একটা ছেলের জন্য সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেল!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy