Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

শেষ ও শুরুর দিনে বেপরোয়া শহর

বর্ষবরণের রাতে ন’টার পর থেকেই শহরের অলি-গলি হয়ে উঠেছিল উন্মুক্ত ‘ডিজে ফ্লোর’। পুলিশ থেকে এলাকার বয়স্কেরা শব্দতাণ্ডবে তখন একই বিন্দুতে।

উচ্ছৃঙ্খল: বর্ষবরণের রাতে হেলমেটহীন বাইক আটকানোর চেষ্টায় পুলিশকর্মী। সোমবার, পার্ক স্ট্রিটে। ছবি: শৌভিক দে

উচ্ছৃঙ্খল: বর্ষবরণের রাতে হেলমেটহীন বাইক আটকানোর চেষ্টায় পুলিশকর্মী। সোমবার, পার্ক স্ট্রিটে। ছবি: শৌভিক দে

সৌরভ দত্ত ও নীলোৎপল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:১৮
Share: Save:

মস্তিষ্কে নিয়ন্ত্রণ নেই। নিজের দু’ হাতেও নিয়ন্ত্রণ নেই। নিয়ন্ত্রণ নেই গতির তুফান তোলা মোটরবাইকেও!

একই রকম ভাবে নিয়ন্ত্রণ নেই আতসবাজির শব্দতাণ্ডব এবং অলি-গলিতে ‘ডিজে নাইট’-এর বেলাগাম উচ্ছৃঙ্খলতায়। বর্ষশেষ এবং বর্ষবরণে কলকাতার মেজাজ যেন নিয়মে নাস্তি!

বর্ষবরণের রাতে ন’টার পর থেকেই শহরের অলি-গলি হয়ে উঠেছিল উন্মুক্ত ‘ডিজে ফ্লোর’। পুলিশ থেকে এলাকার বয়স্কেরা শব্দতাণ্ডবে তখন একই বিন্দুতে। অসহায় নিরব দর্শক হওয়া ছাড়া তাঁদের যেন কিছুই করার নেই। রাত যত বেড়েছে ততই বেড়েছে নিয়ন্ত্রণহীন মোটরবাইকের দাপট। কাউকে মোটরবাইক চালাতে চালাতেই অসংলগ্ন ভাবে‌ চিৎকার করতে দেখা গিয়েছে। কেউ আবার বাইক থামিয়ে মাঝ রাস্তায় শুয়ে পড়ে ঘোষণা করতে শুরু করেন, ‘‘হ্যাপি নিউ ইয়ার!’’ বেশির ভাগই আবার অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় দু’হাত পিছনে মুড়ে চালকের পিঠে ঝুঁকে পড়ে থেকেছেন গোটা রাস্তা। অনেকে আবার গলিপথ ছেড়ে শব্দবাজি ফাটাতে সরাসরি বেছে নিয়েছিলেন রাজপথকে। যা দেখে প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, ‘উৎসবের ছাড়’ দুর্গাপুজোয় ছিল, কালীপুজোতেও। বড়দিনেও ছিল বর্ষবরণেও রয়েছে।

বর্ষবরণের ‘প্রাইম টাইমে’র বহু আগে সন্ধ্যা থেকেই শহরের বিভিন্ন গলি, মাঠ দখল করে ডিজে-র শব্দতাণ্ডব শুরু হয়ে গিয়েছিল বলে অভিযোগ। কান ফাটানো

আওয়াজে অনেকেই রাতভর ঘুমোতে পারেননি বলে দাবি। বিকট শব্দে খাটের তলায় সিঁটিয়ে থেকেছে পোষ্যেরাও। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিয়মের কড়াকড়ি উড়িয়ে পাড়ায় পাড়ায় ছাদের ‘কনসার্ট’! রাত ১১টায় শরৎ বসু রোডে শিশুমঙ্গল হাসপাতালের উল্টোদিকের গলিতে এমনই আসর বসেছিল। সেখানে ডিজে ফ্লোরের আমেজ আনতে মাঝে মধ্যেই ‘ফগ স্মোকে’র যন্ত্রে চাপ দেওয়া হচ্ছিল। এ সবই সেই ‘উৎসবের ছাড়’,

বলছেন অনেকেই।

সেই ছাড়ের পরিণাম যে কী হতে পারে তা বোঝা গিয়েছে রাত বাড়তেই। রাত ১২টার আগে থেকে যে বাইকারেরা রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, তাঁরাই মুখ থুবড়ে পড়েন মধ্যরাতে। পুলিশ নিজেই জানিয়েছে, বর্ষবরণের রাতে শহরে মোটরবাইক দুর্ঘটনা ঘটেছে অন্তত ছ’টি। কয়েক জন হাসপাতালে ভর্তি। মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন ১৮২ জন। মোট গ্রেফতার হয়েছেন ২৬৭ জন।

রাত দেড়টা নাগাদ রাসবিহারী কানেক্টর ধরে রুবি মোড়ের দিকে বেপরোয়া গতিতে ছুটছিল তিনটি মোটরবাইক, একটি স্কুটার এবং একটি মোপেড। ইঞ্জিনের ক্ষমতা এক না হলেও তাদের গতির

প্রতিযোগিতা চলছিল! বেশির ভাগের মাথায় হেলমেট নেই। রাজডাঙা মেন রোডের কাছে একটি মোটরবাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়। আহতদের পাঠাতে হয় বাইপাস সংলগ্ন একটি বেসরকারি হাসপাতালে। বাকিদের গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে গড়িয়াহাট পেরিয়ে এতটা রাস্তা হেলমেট ছাড়া মোটরবাইক চালিয়ে তাঁরা এলেনই বা কী করে? ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশকর্মীরা প্রশ্ন এড়িয়ে শুধু বললেন, ‘‘দেখা হচ্ছে।’’

যদিও বর্ষবরণের রাতে শহরের মোড়ে মোড়ে পুলিশের ধরপাকড় ওই ‘দেখা হচ্ছের’ স্তরেই আটকে ছিল বলে অভিযোগ। প্রত্যক্ষদর্শীরা

জানাচ্ছেন, একমাত্র পার্ক স্ট্রিট মোড়ের কাছের এলাকা ছাড়া বেশির ভাগ রাস্তাই রাতে অরক্ষিত ছিল। পার্ক স্ট্রিট মোড়ের কাছে হেলমেট ছাড়া এবং অসংলগ্ন অবস্থায় মোটরবাইক চালাতে দেখলেই থামিয়ে চাবি খুলে নিচ্ছিলেন পুলিশকর্মীরা। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, শাস্তি তো সে রকম নয়। সামান্য জরিমানা এবং লাইসেন্স কয়েক দিনের জন্য সাসপেন্ড থাকার পরেই পার পেয়ে যাবেন চালকেরা। তাই বেপরোয়া চালকদের গায়েই লাগে না। সেই সঙ্গে প্রশ্ন, পার্ক স্ট্রিট এলাকার মতো সর্বত্র পুলিশি সক্রিয়তা চোখে পড়ল না কেন? অন্য বারের মতোই চুপ কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্র্যাফিক) মিতেশ জৈন। লালবাজারের এক কর্তা আগের মতোই বলেন, ‘‘কত জন ধরা পড়েছে দেখুন। পুলিশ রাত-দিন এক করে চেষ্টা করছে। সচেতনতা প্রচারেও জোর দিচ্ছি।’’

পুলিশি প্রচার যে কাজেই লাগছে না তার আরও এক ছবি মিলল অরবিন্দ সেতুর কাছে। মোটরবাইক

চালাতে চালাতে হাইটবার দেখাতে ব্যস্ত চালক বাইক তুলে দিলেন ফুটপাতে। কোনও মতে রক্ষা পেলেও মোটরবাইকের অবস্থা খারাপ। চালককে বলতে শোনা গেল, ‘‘হেলমেট থাকায় বেঁচে গেছি।’’

নতুন বছরেও কী ভুলের মাসুল দেওয়ার আগে বুঝতে শিখবে শহর? প্রশ্ন এবং সংশয় থেকেই যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kolkata Traffic Kolkata Police Drunk Driving
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE