Advertisement
০৫ মে ২০২৪
Same Sex Relationship

সমপ্রেমে সম-অধিকারের আশায় পথ চেয়ে প্রান্তজনেরা

বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু অবশ্য প্রেমই শিখিয়েছে অভিনেতা-বাচিকশিল্পী সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে। তাঁর কাছে সম-অসম প্রেম বলে কিছু হয় না।

A glimpse of Valentine\'s Day celebration in Maidan

উদ্‌যাপন: প্রেম দিবসের বিনোদন। মঙ্গলবার, কলকাতা ময়দানে।  ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

স্বাতী মল্লিক
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৬:১০
Share: Save:

‘প্রেমের জোয়ারে, ভাসাবে দোঁহারে— বাঁধন খুলে দাও…’।

প্রেমদিবসে বাঁধনহারা প্রেমের উদ্‌যাপন দিকে দিকে। কিন্তু তা কি শুধুই নারী-পুরুষ যুগলের জন্যই নির্দিষ্ট? যাঁরা সমাজের চোখে ‘অন্য রকম’, যাঁরা সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যেই ভাল-বাসা খুঁজে পান, তাঁরা কি হাতে হাত রেখে শহরের পথে হেঁটে যাওয়ার ভরসা পান? সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রেমের অধিকার অর্জন করতে পারেন প্রেমের দিনে?

ছেলে সমকামী, এই কথা শুনে এ শহরেরই এক মায়ের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘‘দাঁড়া, সমপ্রেম নিয়ে একটু পড়াশোনা করে নিই।’’ সমকামিতা আজ ‘অপরাধ’ না হলেও এখনও সমাজের একাংশের এ নিয়ে কৌতূহল, ঘৃণাবোধ, বিরোধিতার মানসিকতা রয়েছে। ২০১৮ সালে ৩৭৭ ধারা প্রত্যাহারের পরেও ওঠে ‘গেল গেল’ রব। তাই তো প্রেমযাপনে রেস্তরাঁয় খেতে গেলে পাশের টেবিল থেকে চাপা মন্তব্য উড়ে আসে, ‘‘দেখ দেখ, জ্যান্ত জোড়া লেসবিয়ান।’’ প্রাইড ওয়াকে ছেলের ছবি দেখে উদ্বিগ্ন বাবা জানতে চান, ‘‘অন্য কেউ সমকামী হচ্ছে হোক, তুই কেন?’’

এ শহরের সমকামীদের কাছে তাই প্রেমের দিনের আবেগ তেমন নেই। কারণ, প্রেমযাপনের থেকে সমাজের রক্তচক্ষুটাই কঠিন হয়ে দেখা দেয়। বাসে সামনের আসনে বসা প্রেমিক-প্রেমিকার মতোই একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে বসার সাহসটুকু দেখাতে পারেন না পিছনে বসা সমপ্রেমী যুগল। হাতে হাত রাখতেও ইতস্তত করতে হয়। ফুচকা খেতে গিয়ে কটাক্ষের শিকার হতে হয়।

তাই অন্দরমহলে কেক-ওয়াইন-উপহার বিনিময়ের মধ্যেই প্রেমযাপনকে সীমিত রাখেন শ্রী মুখোপাধ্যায়-সুচন্দ্রা দাস। পেশায় বিপণন উপদেষ্টাশ্রী বলছেন, ‘‘সামাজিক ভাবে উদ্‌যাপন করতেই ২০১৫ সালে দু’জনে বিয়ে করেছিলাম। যৌথ জীবনে তাই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নয়, ঘরে বসে নীরব প্রেমযাপনে বিশ্বাসী। তবে লোকে কী বলবে, সেই ভাবনাকে ছোট থেকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে এসেছি।’’

সকলের অবশ্য এতটা মানসিক দৃঢ়তা থাকে না। রাজারহাটের বাসিন্দা, পেশায় দন্ত চিকিৎসক কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় নিজের সমকামী সত্তা প্রথম চিনেছিলেন পঞ্চম শ্রেণিতে, যখন ‘কহো না প্যায়ার হ্যায়’ দেখে ঋত্বিক রোশনের প্রতি আকর্ষিত হন। পরে পুরুষদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন। আরও পরে বুঝেছেন, নারী-পুরুষ উভয়ের প্রতিই আকর্ষণ আছে তাঁর। তবু এত দিনেও বাড়িতে জানাতে পারেননি কৃষ্ণেন্দু। ইচ্ছে থাকলেও প্রেমদিবসকে প্রেমযাপনের হাতিয়ার করে তুলতে পারেননি। ‘‘যতই ওটিটি-তে সমকামিতার সিরিজ় হোক, সোশ্যাল মিডিয়ায় সমপ্রেমের কথা হোক, ৩৭৭ ধারা ইতিহাস হোক, কিছু মানুষ সহানুভূতিশীল হোক, তবু বৈষম্য, ঘৃণাবোধটা রয়েই গিয়েছে’’— বলছেন কৃষ্ণেন্দু।

বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু অবশ্য প্রেমই শিখিয়েছে অভিনেতা-বাচিকশিল্পী সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে। তাঁর কাছে সম-অসম প্রেম বলে কিছু হয় না। প্রেমের কোনও বিভাজন করতেও নারাজ তিনি। তাই বিশেষ দিনকে প্রেমদিবস বলে দাগিয়ে দিতেও আপত্তি আছে তাঁর। বলছেন, ‘‘বর্তমানে প্রেমের নামে যা চলছে, তা তো নির্মমতা, অসহিষ্ণুতারই নামান্তর। আইন করে সমকামীদের অধিকার মান্যতা পেলেও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে কি? সঙ্কীর্ণ মানসিকতারউন্নয়ন ঘটলে তবেই প্রেমের সংজ্ঞা বদলাতে পারে।’’

তাই সমকামী বিয়ে নিয়ে আইন যে পথেই এগোক, প্রেমেসমানাধিকার পেতে যে এখনও হেঁটে যেতে হবে বহু দূর— তা বিলক্ষণ জানেন তাঁরা। ৩৭৭ রদের পরে বিয়ে, সন্তান, সম্পত্তি— সবেতেই অধিকারের আশায় পথ চেয়ে আছেন এই প্রান্তজনেরা। কৃষ্ণেন্দুর কথায়, ‘‘প্রেমদিবসে বিজ্ঞাপন থেকে দোকান, বাজার— সর্বত্র আজও আমরা ব্রাত্য। যে দিন সমপ্রেম নিয়ে আর লেখালিখির প্রয়োজন পড়বে না, প্রেমিক বা স্বামী আছেন বললে কেউ দ্বিতীয় বার আমার দিকে তাকাবেন না— সেই দিনই বুঝব সমানাধিকার মিলেছে। সেই দিনের আশাতেইদিন গুনছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE