Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
general-election-2019-west-bengal

ফুলে ফুলে টক্করে উদ্বেগেও ঠাট্টা

ক্যারমের সঙ্গী বাসুদেব চক্রবর্তী, সুজয় দাস, খোকনদা ওরফে সমীর সূত্রধরেরা হাততালি দিয়ে বলছেন, ‘‘দিদির কালকের খেলাটায় গোটা ইন্ডিয়া হাততালি দেবে, দেখবেন।’’

চর্চা: ভোটের ফলাফল নিয়ে আলোচনা। কালীঘাট এলাকার একটি ক্লাবে। বুধবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

চর্চা: ভোটের ফলাফল নিয়ে আলোচনা। কালীঘাট এলাকার একটি ক্লাবে। বুধবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৯ ০১:৩৯
Share: Save:

মিঠুন চক্রবর্তীর সংলাপ থেকে গীতার শ্লোক— সবই মিশে যাচ্ছে শহরের প্রাক্-ভোটফল সন্ধ্যায়।

তবে দক্ষিণের সঙ্গে উত্তরের মেজাজের দুস্তর ফারাক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির গলির সমান্তরাল রাস্তায় সরস্বতী স্পোর্টিং ক্লাবে টিভি-টা বন্ধ ছিল বুধবার সন্ধ্যায়। জমিয়ে ক্যারম চলছে সেখানে। পরপর কয়েকটি কালো ঘুঁটি সাফ করে শেষটা বোর্ডের ডান দিকে দুরূহ কোণে ‘টাঙ্কি’ নিলেন জ্যোতির্ময় দাস ওরফে জনি। বার তিনেক গোঁত্তা খেয়ে বোর্ডের উল্টো মুড়োয় পড়ে থাকা ঘুঁটিটায় স্ট্রাইকারের আলতো ছোঁয়াতেই গেম ওভার! মুখে তৃপ্তির হাসি মেখে জনি বললেন, ‘‘বিষ্যুদবারের খেলাটাও এমনই হবে, বুঝলেন! মারব এখানে, টের পাবে দিল্লিতে!’’

ক্যারমের সঙ্গী বাসুদেব চক্রবর্তী, সুজয় দাস, খোকনদা ওরফে সমীর সূত্রধরেরা হাততালি দিয়ে বলছেন, ‘‘দিদির কালকের খেলাটায় গোটা ইন্ডিয়া হাততালি দেবে, দেখবেন।’’ ওই তল্লাটের আড্ডাধারীদের সকলকে নাকি ‘মমতাদি’ ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন! বাসুদেববাবুর বাড়ির ঠিক পিছনে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি।

নিজেকে ‘বেকার ছেলে’ পরিচয় দিয়ে রোগাটে প্রৌঢ় আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে কাজটাজও খুঁজছেন। তবে ‘দিদি’র সঙ্গে সম্পর্কটা সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে! ক্লাবের ইয়ারদোস্তরা বলে চলেছেন, ‘‘আমরা হচ্ছি জলের মতো স্বচ্ছ, কিছুতেই অন্য সিম্বলে (প্রতীক) হাত যাবে না।’’

কিন্তু জল তো আকারহীন! আধার বা পাত্রটাই সব। পাত্র-পাত্রী কি পাল্টে যায় না ক্ষেত্র বিশেষে? ক্লাবের উল্টো দিকের দেওয়ালে ছড়া। ‘পদ্মকাঁটায় বিষের হুল, দেশ বাঁচাবে তৃণমূল’! চটি খুলে রাধাগোবিন্দ ও ভোলেবাবার মন্দিরে পরপর পেন্নাম ঠুকে সেই স্লোগানের দিকে আঙুল তুলে খোকনদা বললেন, ‘‘পাড়ার দু’-একটা ছেলে অন্য কিছু করতে পারে! তাতে কী? কাউন্টিংয়ের পরে আসবেন। কথা দিচ্ছি, মিষ্টি খাওয়াব।’’

সমর্থনের এই অকপট ভাষাটাই কিন্তু হেঁয়ালিময় হয়ে ওঠে ভবানীপুরের পদ্মপুকুরের কাছে ‘গুজরাতি সমাজ ভবন’-এ ঢুকলে। অনাহূত ঢুকে পড়েছি ভাগবত পাঠের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। মাথায় পাগড়ি, কপালে টিকা আঁকা জবরজং পোশাকের পুরুষ, জমকালো শাড়ি-সালোয়ারের মেয়েদের ভিড় চারপাশে। কান পাততেই মালুম হয়, ধর্মানুষ্ঠান শেষে কচুরি-দইবড়া ভোজের ফাঁকে সেখানেও হানা দিয়েছে ভোটচর্চা। তপসিয়ার অলন্তিকা সোনি, বাঙুরের স্নেহা আগরওয়াল বা পাড়ার মেয়ে রুচিকা রাজরা নিশ্চিত, ‘মোদী ফির আয়েগা’!

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

হাল্কা গলা খাঁকারি দিয়ে আলাপ জমানোর চেষ্টা করে জানতে চাওয়া গেল, আর পশ্চিমবঙ্গে কী হবে? শুনেই অলন্তিকার হাসি, ‘‘মুখ খুলে জেলে যাব নাকি!’’ কলকাতায় ভাগবত শোনাতে আসা বৃন্দাবনের পণ্ডিতকে আপ্যায়নের ফাঁকে ললিত নাগোরি বললেন, ‘‘আমার সঙ্গে লোকাল লিডারদের ভাল সম্পর্ক দাদা, মিথ্যা বলব না! তবে এটা তো দিল্লির ভোট, তবেই বুঝুন!’’ স্থানীয় যুবক রাহুল শরাফ চিবুকের হাল্কা দাড়িতে হাত বুলিয়ে ‘ইশারা হি কাফি হ্যায়’ বোঝালেন!

এ দিন বিকেলেই ধর্মতলার টিপু সুলতান মসজিদের গলিতে ইফতারি খাবার কিনতে কিনতে কলেজ স্ট্রিটের মেসবাসী রবিউল হক (নাম পরিবর্তিত) বলছিলেন, ‘‘এই ভোটটায় লোকজন সত্যিই অদ্ভুত ভাবে ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছে। ভাষা বা ধর্মের ভেদে ভোটের চিহ্ন পাল্টে যাওয়াটা এতটা ছিল না আগে এখানে।’’ মুর্শিদাবাদ থেকে শহরে পড়তে আসা তরুণ তাঁর নামটা গোপন রাখতে বললেন। উৎকণ্ঠার ছাপ লেকের কাছে গোবিন্দপুরের ক্লাবঘরেও। সুকিয়া স্ট্রিট থেকে আসা ‘দিদি’কে ক্যানিংয়ের টুম্পা হালদার, সুভাষগ্রামের সনকা সর্দারেরা বলছিলেন, ‘‘এ বার শুনছি, মারপিট হবে গো! বাবুর বাড়ি কাজ করে তেমন হলে কোথাও একটা থেকে যাব।’’

শহরের অন্য মাথায় পাইকপাড়ার নর্দার্ন অ্যাভিনিউয়ে রাত আটটা নাগাদ চা খাচ্ছিলেন এক দল সিপিএম সমর্থক। ‘‘কী রে, কোন ফুলে দিলি তোরা?’’ পরিচিত এক যুবকের চাপা স্বরের রসিকতায় সপ্রতিভ জবাব, ‘‘ছোট-বড় কোনও ফুল নয়। মা ফুলেষু কদাচন!’’ আর এক জন হাসলেন, ‘‘কোনও একটা ফুল তো হারছেই!’’ ভোট-বাক্স খোলার আগের সন্ধ্যায় উদ্বেগের মধ্যেও হাসতে ভোলেনি কলকাতা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE