Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

ফেসবুক-যুগে প্রচারে নামলে হয়রান হত কি টিনটিনও

জোর বেঁচেছে টিনটিন। সঙ্গে ক্যাপ্টেন হ্যাডক আর প্রফেসর ক্যালকুলাসও। ভাগ্যিস সেই সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না! থাকলেই বিশ্ব জুড়ে ট্রোলড। কয়েক লক্ষ ভিউ। অগুনতি শেয়ার!

দীপক দাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৩২
Share: Save:

জোর বেঁচেছে টিনটিন। সঙ্গে ক্যাপ্টেন হ্যাডক আর প্রফেসর ক্যালকুলাসও। ভাগ্যিস সেই সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না! থাকলেই বিশ্ব জুড়ে ট্রোলড। কয়েক লক্ষ ভিউ। অগুনতি শেয়ার!

‘বিপ্লবীদের দঙ্গলে’। স্বৈরতন্ত্রী শাসক জেনারেল টাপিয়োকার খপ্পর থেকে পালিয়েছে টিনটিনরা। পালানোর পথেই তাদের বাঁচায় জেনারেল আলকাজার। এই আলকাজারকে হটিয়েই সান থিয়োডোরাসের ক্ষমতা দখল করেছে টাপিয়োকা। আলকাজার চায় টাপিয়োকাকে হটিয়ে ক্ষমতায় ফিরতে। টিনটিনরা চায় বন্ধু কোকিলকণ্ঠী বিয়াঙ্কা কাস্তাফিয়োর আর মানিকজোড় রনসন-জনসনকে টাপিয়োকার কবল থেকে উদ্ধার করতে। দু’জনেরই লক্ষ্য টাপিয়োকা। জঙ্গলের পথে যেতে যেতে টিনটিনদের সঙ্গে দেখা হয় ডক্টর রিজওয়েলের সঙ্গে। রিজওয়েল আরামবায়া নামে এক জনজাতি গোষ্ঠীর সঙ্গে জঙ্গলেই থাকে। আরামবায়া সর্দার আভাকুফি টিনটিনদের আমন্ত্রণ জানায় দুপুরের খাবার খেতে। খেতে বসে রিজওয়েল সাবধান করে দেয় টিনটিনকে, ‘ভাল না লাগলেও ভাল লাগার ভান করো। ওদের খুশি রাখা খুব দরকার...’।

কেন খুশি রাখা দরকার? জেনারেল টাপিয়োকাকে ক্ষমতা থেকে হটাতে। টাপিয়োকা আরামবায়াদের কোনও উন্নতি করেনি। বরং আকাশ থেকে হুইস্কির বোতল ফেলে পুরো জনজাতিকে মাতাল করে দিয়েছে। রিজওয়েল তো টিনটিনকে বলেছিল, ‘টাপিয়োকাকে অনেক জবাবদিহি করতে হবে...’। তাই আরামবায়াদের খাবার সোনামুখ করে খেয়ে প্রমাণ করতে হবে, আমরা তোমাদেরই লোক। কোনও মিল পাওয়া যাচ্ছে জম্বুদ্বীপের নির্বাচনী প্রচারের সঙ্গে? যে দ্বীপে নির্বাচন এলেই দলে দলে লোকজন মাঠে নেমে পড়েন ‘তোমাদের লোক’ প্রমাণে। কেউ মাঠে নেমে গম কাটছেন, কেউ ট্রাক্টর চালাচ্ছেন। কেউ দলিত, জনজাতি গোষ্ঠীর (জম্বুদ্বীপের আরামবায়া) কারও বাড়িতে পাত পেড়ে খেয়ে নিজেদের মাটির মানুষ প্রমাণ করতে চাইছেন। যদিও তাঁদের মানসিক জপমালা, ‘মাটিতে এখন যারা ঠেকাবে চরণ/ ভোট-আসনের মালিক তারাই হন’।

কিন্তু এ সবই যে অনভ্যাসের ফোঁটা। তাই চড়চড় করে গুবলেট করবেই। করেও। এক প্রার্থী গম কাটতে নেমে গেলেন ঝলমলে শাড়ি পরে। সঙ্গে সঙ্গে নেট-সমাজের শিকার। ‘এলিয়েন নাকি?’, ‘হেলিকপ্টার থেকে চাষি নামছে, অচ্ছে দিন এল রে’। ইত্যাদি। আসলে সেই প্রার্থীরই বা কী করার আছে! ছিলেন রুপোলি পর্দার স্বপ্নবালিকা। চলতে চলতে হঠাৎ নিজের মাথায় তুলে নিতেন কোনও শ্রমজীবী মহিলার মাথার কাঠের বোঝা। যা দেখে নায়ক গেয়ে উঠত, ‘তেরে চহেরে মে ও জাদু হ্যায়...’। ফলে ভোট প্রচারেও তিনি ‘পুরি ফিল্মি’। জনতাই এখন তাঁর নায়ক। ভেবেছিলেন, এমন কাজে তাঁরা খুশি হয়ে গেয়ে উঠবেন, ‘... তেরে বিনা ম্যায় কিসকো ভোট ডালু’। আর এক প্রার্থী গ্লাভস পরে জনতার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিপাকে। তিনিই আবার রিকশায় তোয়ালে পেতে বসে বিপাক বাড়ান। হাওড়ার এক প্রার্থী ট্রাক্টরে করে জেলাশাসকের দফতরে মনোনয়ন জমা দিতে গিয়েছিলেন। মাথায় ছিল ফেট্টি। সেই তোমাদেরই লোক।

এই অভিনয় দশকের পর দশক ধরে চলেছে। লোকে হেসেছেন, সমালোচনা করেছেন। কিন্তু অভিনয় থামেনি। সবই তো সেই রিজওয়েলের কথা মতো, ‘ওদের খুশি রাখা খুব দরকার...’। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলছেন, ‘‘এই যে যাঁরা আমি তোমাদেরই লোক বলছেন, সে সবে আজকাল কেউ বিশ্বাস করেন না। তাঁরা জানেন, ভোটবাবুরা আসেন, বলেন, তার পরে ভোট হয়ে গেলে চলে যান। তাঁদের আর সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না।’’ তবুও চলে দলিতের দাওয়ায় বসে পাত পেড়ে খাওয়া। খাবারের ক্ষেত্রে তো পছন্দের একটা ব্যাপার আছে? কথাতেই আছে মাছ-ভাতে বাঙালি। কিন্তু তার মুখেও যদি ভাত আর কাঁচা মাছের জাপানি মণ্ড সুশি ঠুসে দেওয়া হয়? অনভ্যাসে খারাপ লাগতেই পারে। তেমনই ধোকলা, কাধি, খাট্টা-মিঠা ভাত খাওয়া কেউ বাংলার খাবারেও চমকে উঠতে পারেন।

টিনটিনরা তো প্রায় ধরাই পড়েছিল। আরামবায়াদের আটনোশ নামে খাবার ভীষণ ঝাল। মুখে দিতেই টিনটিন, ক্যালকুলাসের দু’কান দিয়ে গরম হলকা। তবু সর্দার জিজ্ঞাসা করে কেমন খেতে? জ্বলে যাওয়া বুক চেপে টিনটিন বলেছিল, ‘ও দারুণ!’ সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে হলে কী হাল হত টিনটিনদের! আটনোশ খেয়ে আঁতকে ওঠা টিনটিনদের ভিডিয়ো ভাইরাল। নেট-জনতা ক্ষিপ্ত। শ্বেতাঙ্গ দুষ্টুদের হাত থেকে রেড ইন্ডিয়ান বালক জোরিনোকে (সূর্যদেবের বন্দি) বাঁচিয়েছিল টিনটিন। আফ্রিকার দরিদ্র মানুষদের আন্তর্জাতিক দাস ব্যবসায়ীর কবল থেকে বাঁচাতে (লোহিত সাগরে হাঙর) লড়াই করেছিল। কিন্তু টিনটিনের কী অবনমন! জনজাতিদের অপমান করেছে তাদের বাড়ি গিয়ে!

অন্য একটা সম্ভাবনার কথা বললেন বাংলায় টিনটিন নিয়ে কাজ করা কার্টুনিস্ট মহফুজ আলি। ভান সর্বস্ব ভোট প্রচারের সময়ে টিনটিন যদি ভারতে আসত? মহফুজ বলেন, ‘‘টিনটিন যেহেতু সাংবাদিক, তাই অভিযানে নেমে যেত। আইটি সেলগুলোর মাথাদের কীর্তি ফাঁস করে দিত। যে সেলগুলো সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে চলেছে।’’ মাহফুজ জানাচ্ছেন, অভিযানের আগে টিনটিনকে কিছু কাজ করতে হত। কোকিলকণ্ঠীকে তো একটা দল নির্বাচনী ‘থিম সং’ গাওয়ার জন্য নিয়ে গিয়েছিল। ক্যালকুলাস টেলিভিশন চ্যানেলে এক দলের হয়ে প্যানেল ডিসকাশনে বসে কানে শুনতে না পেয়ে এ-স্যাট রকেট নিয়ে বলে চলে এলেন। ক্যাপ্টেন গ্রেফতার হতে বসেছিলেন। চোলাইয়ের টোপে একটা দলের হয়ে প্রচার করতে গিয়েছিলেন। খালি গরমে কুট্টুস প্রচুর জল খেয়ে ল্যাম্পপোস্ট দেখলেই থেমেছে। অনেক কষ্টে টিনটিন বন্ধুদের বাঁচায়।

এত খোঁচা, এত সমালোচনা। তবুও কেন ভান? মার্ক টোয়েনের হাক্‌লবেরি ফিনকে মনে পড়ছে। টম সয়ারের বন্ধু। বখাটে হিসেবেই পরিচিত। তবুও টমের ভালমানুষ পলি মাসি তাকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু নিয়মের বন্ধনে থাকতে নারাজ হাক। গা চুলকোলে জনসমক্ষে কণ্ডুয়ন নাস্তি। এমন সভ্যতার বাঁধন টুটে সে আবার পথে। রাজনীতিকদের তো পালানোর পথ নেই। ক্ষমতার টান। তাই তাঁদের অস্বস্তির কণ্ডুয়ন চেপে মুখে ভাল লাগার ভানের প্রলেপ লাগাতে হয়।

তবুও ফাঁস হয়ে যায় রাজনীতির ব্ল্যাক কমেডি। এই তো সে দিন এক দলবদলু তাঁর পুরনো দলের সাংসদের ‘কীর্তি’ ফাঁস করলেন। ওই সাংসদ নাকি হাসি হাসি মুখে সমর্থকদের সঙ্গে হাত মেলান। কিন্তু আড়ালে হস্ত শোধক দিয়ে হাত শোধন করে নেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hema Malini Troll Election Campaign Tintin
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE