শব্দবাজি নিয়ে নিষেধাজ্ঞা বা হুঁশিয়ারি ছিল যথেষ্টই। তবু সেই শব্দবাজি পোড়াতে গিয়েই এ বারও কালীপুজো-দেওয়ালির রাতে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে জায়গা পেতে হন্যে হয়ে ঘুরেছেন বহু মানুষ।
ইমার্জেন্সিতে প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে ফেরত যাওয়ার সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, তাঁদের কাছে এ বারের আলোর উৎসব কোনও আলাদা বার্তা বয়ে আনেনি। প্রতি বারের মতো এ বারও সন্ধ্যা হতে না হতেই পোড়া শরীর নিয়ে কাতরাতে কাতরাতে হাসপাতালে ভিড় করা মানুষের সংখ্যাটা ছিল যথেষ্টই বেশি। পরিকাঠামোর অভাব থাকায় অনেককেই হাসপাতালে জায়গা দেওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে আলোর উৎসব এ বারও অনেকের কাছে যন্ত্রণার উৎসব হয়েই থেকেছে।
গত দু’দিন এসএসকেএম হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যাঁরা ভর্তি হয়েছেন, তাঁদের একটা বড় অংশই বাজির আগুনের শিকার। প্রাথমিক ভাবে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে ডাক্তাররা জানতে পেরেছেন, এঁদের অনেকেই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন শব্দবাজি পোড়াতে গিয়ে। হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক অরিন্দম সরকার বলেন, ‘‘এত প্রচার, এত সাবধানতা সত্ত্বেও বহু মানুষকে সতর্ক করা গেল না, এটাই আক্ষেপের। এঁদের প্রায় সকলেরই দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা দরকার। আমাদের সব রকম চেষ্টা সত্ত্বেও এঁদের কারও কারও চেহারায় কিছু স্থায়ী বিকৃতি থেকে যাওয়ারও ভয় রয়েছে।’’
চিকিৎসকেরা জানান, প্রতি বছরই বাজির আগুনে পুড়ে যাঁরা হাসপাতালে আসেন, তাঁরা সকলেই কাতরাতে কাতরাতে এমন ‘ভুল’ আর না করার কথা বলেন। কিন্তু পরের বছরও ছবিটা বদলায় না। অন্য কেউ না কেউ সেই একই ‘ভুল’ করে হাসপাতালে ভর্তি হন। ই এম বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক এ দিন বলেন, ‘‘আমার অধীনে এক .যুবক ভর্তি হয়েছেন, তাঁর শরীরের ৪৫ শতাংশ পুড়ে গিয়েছে। কথা বলে জানতে পারলাম, চকোলেট বোমা হাতে নিয়ে ফাটাতে গিয়েই এই বিপত্তি ঘটে। শনি-রবি দু’দিন ফাটাবেন বলে তিনি ১০০ চকলেট বোমা কিনেছিলেন।’’
শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের সুপার সৌমাভ দত্ত জানান, এই মুহূর্তে তাঁদের ছয় শয্যার বার্ন ইউনিটের চারটি শয্যাই কালীপুজোর দিন অগ্নিদগ্ধ রোগীর দখলে। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের হাসপাতালে আইটিইউ নেই। তাই ৪০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেলে আমরা এখানে চিকিৎসা করতে পারি না। এসএসকেএমে রেফার করতে হয়। এ কারণেই রবিবার দুপুরে ৯৫ শতাংশ পোড়া অবস্থায় এক মহিলা তাঁদের হাসপাতাল পৌঁছলে তাঁরা কিছু ওষুধপত্র দিয়ে এসএসকেএমেই রেফার করেছিলেন। এসএসকেএম সূত্রে খবর, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
একই পরিস্থিতি বাঙুর হাসপাতালের বার্ন ইউনিটেও। আগুনে পোড়া রোগীর ভিড় শনিবার বিকেল থেকেই বেড়েছে। সোমবার সকালে বাঙুরের মেন গেটের সামনে বসে অঝোরে কাঁদছিলেন অলকা দাস। স্বামী রবিবার সন্ধ্যায় বাজি ফাটাতে গিয়ে পুড়ে গিয়েছেন। ডাক্তারেরা জানিয়েছেন, শরীরের ৫০ শতাংশেরও বেশি পুড়ে গিয়েছে তাঁর। অলকার কথায়, ‘‘চম্পাহাটি থেকে শখ করে প্রচুর চকোলেট বোমা, দোদমা কিনে এনেছিল। অনেক বারণ করেছিলাম, শোনেনি। এখন ওর কিছু হয়ে গেলে আমাদের গোটা পরিবারটাই ভেসে যাবে।’’
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালেই গত দু’দিনে একই ছবি। এমনিতেই রাজ্যে আগুনে পোড়া রোগীর চিকিৎসার পরিকাঠামো কম। এ সব দিনে পরিকাঠামোর সেই অভাব খুব বেশি রকমের প্রকট হয়ে দেখা দেয় বলেই মনে করছেন চিকিৎসকেরা। তাঁদের মতে, আগুনে পোড়ার পরে দ্রুত চিকিৎসা শুরু হওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি। ১৫ শতাংশের বেশি পুড়ে গেলেই তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত। তা না হলে সংক্রমণ ছড়ানোর ভয় থাকে। অনেকটা জায়গা জুড়ে পোড়ার গভীর ক্ষত হলে এবং ধোঁয়া শ্বাসনালীতে পৌঁছে গেলে কিংবা ওই ব্যক্তির ডায়াবিটিস জাতীয় কোনও রোগ থাকলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু হওয়া দরকার। তা না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
এখনও পর্যন্ত এ শহরে অগ্নিদগ্ধ রোগীদের জন্য বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে মোট ১৩০টির মতো শয্যা রয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় এই সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। পুড়ে যাওয়া রোগীকে মেঝেতে ভর্তি করা যায় না। তাই শয্যা ভর্তি হয়ে গেলে হাসপাতালকে রোগী ফেরাতেই হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy