ফুসফুসের কর্কট রোগ। এই রোগকে দীর্ঘদিন ধরে মূলত ধূমপানের সঙ্গে যুক্ত করে দেখা হয়। কিন্তুসাম্প্রতিক গবেষণা ও চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ বলছে, চেনা ছবিটা বদলাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ফুসফুসের কর্কট রোগে আক্রান্ত রোগীদের একটা বড় অংশ কখনও সিগারেট ছুঁয়েও দেখেননি। ইন্ডিয়ানজার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে ভারতে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াবে ৮১ হাজারের কাছাকাছি। ২০১৫ সালে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রায় ৬৪ হাজার।চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, উদ্বেগের বিষয় হল, একটা বড় অংশের মধ্যে (প্রায় ৮০ শতাংশ) এই রোগ ধরা পড়ছে তৃতীয় বা চতুর্থ পর্যায়ে। যার জেরে নিরাময়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। ৬০ হাজারে পৌঁছে গিয়েছে বার্ষিক মৃত্যুহার।এমনকি, আগে পুরুষদের এই রোগ বেশি হলেও এখন মহিলা আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে।স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, মহিলাদের মধ্যে কেন বাড়ছে ফুসফুসের কর্কট রোগ? কেন বড় সংখ্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন অধূমপায়ীরাও?
এই প্রশ্ন কয়েক বছর আগেও ভাবাত চিকিৎসকদের। তবে বর্তমানে এই প্রশ্নের উত্তর কিছুটা হলেও পরিষ্কার। ধূমপান ফুসফুসের কর্কট রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হলেও আর একটা বড় কারণ হিসেবে উঠে আসছে দূষণের কথা। গবেষণা ও হাসপাতাল স্তরেরপর্যবেক্ষণ বলছে, মহিলা ও অধূমপায়ীদের মধ্যে ফুসফুসের কর্কট রোগ বাড়ার নেপথ্যে রয়েছে পরিবেশগত একাধিক বিষয়,যেমন— বাড়ির ভিতরের দূষণ এবং বায়ুদূষণ।
পালমোনোলজিস্ট সুস্মিতা রায়চৌধুরী জানাচ্ছেন, বাড়ির ভিতরের দূষণ বেশি প্রভাব ফেলে মহিলাদের উপরে। একটা বড় অংশের মহিলারা যে শুধু বেশি সময় কাটান তা-ই নয়,রান্নার কাজেও তাঁরা অনেকটা সময় ব্যয় করেন। যে সব বাড়িতে জৈব জ্বালানি— অর্থাৎ, কয়লা, কাঠকুটো, ঘুঁটে ইত্যাদির সাহায্যে রান্না হয়, সেখানে মহিলাদের ফুসফুসে ঢোকে সেগুলির ধোঁয়া এবং তাতে থাকা সূক্ষ্ম ও অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম)। রান্নাঘরে অপর্যাপ্ত বায়ু চলাচল, জানলা-দরজা বন্ধ থাকা বিপদ আরও বাড়ায়। সুস্মিতা বলছেন, ‘‘মহিলাদের ফুসফুসের আকার তুলনায় ছোট হওয়ায় পিএম ২.৫ এবং পিএম ৫ সহজেই ভিতর পর্যন্ত গিয়ে সেখানে বসে যায়। তার জেরে তৈরি হয় ক্রনিক প্রদাহ। এর জেরে যে ফুসফুসের কর্কট রোগ বাড়ছে, তেমন অনেক তথ্য মিলছে বর্তমানে।’’ এ ছাড়া, মহিলাদের ক্ষেত্রে বিশেষ জিনগত মিউটেশন, দেহে ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাব, শহরাঞ্চলে মহিলা ধূমপায়ীদের সংখ্যা বাড়াও উঠে আসছে কারণ হিসেবে।
দীপাবলির পর থেকেই ভারতে ক্রমবর্ধমান বায়ুদূষণের বিষয়টি নিয়ে বেশি করে চর্চা শুরু হয়েছে। দিল্লির মতো শহরে এই সমস্যাগুরুতর হলেও পিছিয়ে নেই কলকাতাও। সারা বছরই এ শহরে দূষণ-মাত্রা উদ্বেগজনক থাকলেও তা আরও বাড়ে শীতের সময়ে। ফুসফুসের উপরে কেমন প্রভাব ফেলে বছরভরের এই দূষণ?
পালমোনোলজিস্ট দেবরাজ যশ জানাচ্ছেন, শিল্পাঞ্চলের ধোঁয়ায় ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ (কারসিনোজেন) থাকে অনেক বেশি মাত্রায়। এই ধোঁয়ার জেরে হওয়া বায়ুদূষণ অধূমপায়ীদের ফুসফুসের কর্কট রোগে আক্রান্ত হওয়ার পিছনে একটি কারণ বলে উঠে আসছে। তিনি আরও বলছেন, ‘‘অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার দেহে তৈরি হওয়া ফ্রি র্যাডিকাল ধ্বংস করে। এই ফ্রি র্যাডিকাল এমন ক্ষতিকর কণা, যা কোষের ডিএনএ-তে আঘাত করে। এই ক্ষতি জমতে জমতে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। কিন্তু বর্তমান জীবনযাত্রায় বহু মানুষই শাক-আনাজ, ফল, ভিটামিনযুক্ত খাবার খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। কায়িক পরিশ্রম কম করছেন। এতে সব রকম কর্কট রোগেরই ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।’’ এর পাশাপাশিই রয়েছে পরোক্ষ ধূমপানের জেরে হওয়া ক্ষতি।
তবে কর্কট রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির নেপথ্যে বেশি করে রোগ নির্ণয়ের বিষয়টিও রয়েছে বলে জানাচ্ছেন দেবরাজ। আগে ফুসফুসের ভিতরে থাকা ছোট নোডিউল পর্যন্ত পৌঁছনো ছিল কঠিন।এখন আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কোথাও কর্কট রোগ ঘাপটি মেরে রয়েছে কিনা, তা নির্ণয় অনেকাংশেই সহজ হয়েছে। ফলে বাড়ছে রোগ শনাক্তকরণের হারও। এখনও ফুসফুসের কর্কট রোগ নির্ণয়ে কোনও জাতীয় স্ক্রিনিং কর্মসূচি নেই। তাই সচেতনতা বেশি জরুরি। তবে, ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে ৪৫ বছর বয়সের পরে স্ক্রিনিং পদ্ধতি হিসেবে কম ডোজ়ের সিটি স্ক্যান করা হয়।
ফুসফুসের কর্কট রোগ সচেতনতার মাস হিসেবে নভেম্বরে তাই নজর রয়েছে সচেতনতা ও প্রাথমিক সতর্কতা বাড়ানো এবং সময় মতো পরীক্ষা করানোর দিকে। কারণ, দ্রুত রোগ নির্ণয়ই বাড়াতে পারে সুস্থতার সম্ভাবনা।
কী কী লক্ষণ দেখে সজাগ হবেন
ক্রমাগত কাশি
বুকে ব্যথা
মুখ দিয়ে রক্ত ওঠা
সামান্য দূরত্ব বা অল্প সিঁড়ি ভাঙলেই শ্বাসকষ্ট
খিদে কমে গিয়ে ওজন হ্রাস
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)