Advertisement
E-Paper

স্ত্রী ও মেয়েকে কুপিয়ে নিজের গলাতেও ছুরি

ভোরের দিকে কান্নার শব্দে চমকে উঠেছিলেন প্রতিবেশী দম্পতি। ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বুঝতে পারেন, কান্নার আওয়াজ আসছে পাশের ফ্ল্যাট থেকেই।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৩৮
বিকাশ কপূর ও রশ্মি কপূর

বিকাশ কপূর ও রশ্মি কপূর

ভোরের দিকে কান্নার শব্দে চমকে উঠেছিলেন প্রতিবেশী দম্পতি। ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বুঝতে পারেন, কান্নার আওয়াজ আসছে পাশের ফ্ল্যাট থেকেই। সমানে কলিং বেল বাজাতে থাকায় ওই বাড়ির চোদ্দো বছরের মেয়েটি দরজা খুলে দিতেই হতভম্ব প্রৌঢ় দম্পতি। খোলা দরজার ভিতরে সারা ঘর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ওই কিশোরীরও সারা গায়ে রক্ত, আর ঘরের দু’দিকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন তার বাবা-মা! মঙ্গলবার ঘটনাটি ঘটেছে বরাহনগরের তিন নম্বর ওয়ার্ডের ফকির ঘোষ লেনে।

অভিযোগ, সোমবার গভীর রাতে পারিবারিক অশান্তির জেরে রান্নাঘরের ছুরি দিয়ে স্ত্রী-মেয়েকে কুপিয়ে নিজের গলা কেটে ফেলেন গৃহকর্তা, পেশায় ব্যবসায়ী বিকাশ কপূর (৩৯)। পুলিশ জানায়, শরীরের বিভিন্ন অংশের শিরা কেটে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জেরে মৃত্যু হয়েছে বিকাশের স্ত্রী রশ্মি কপূরের (৩৩)। বিকাশ ও তাঁর মেয়ে, অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী পূজা আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। বিকাশের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন রশ্মির আত্মীয়েরা।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, বছরখানেক আগে ফকির ঘোষ লেনে ‘অমল ভবন’ নামে চারতলা আবাসনের দোতলার ওই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন বিকাশ। এলাকায় কারও সঙ্গেই সে ভাবে মিশতেন না তিনি। তবে রশ্মি ও পূজা পড়শিদের সঙ্গে একটু-আধটু কথাবার্তা বলতেন।

বিকাশদের লাগোয়া ফ্ল্যাটে থাকেন কানন রায়। এ দিন তিনি জানান, ভোর চারটে নাগাদ কান্নার শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায় তাঁদের। কোথা থেকে শব্দ আসছে বুঝতে প্রথমে প্রথমে বারান্দায় ছোটেন ওই প্রৌঢ়া ও তাঁর স্বামী। কিন্তু রাস্তায় কারও দেখা মেলেনি। এর পরে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই তাঁরা বুঝতে পারেন, কান্নার শব্দ আসছে বিকাশদের ফ্ল্যাট থেকে।

এর পরেই লাগাতার বিকাশদের ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজাতে থাকেন কাননদেবী। তাঁর কথায়, ‘‘বেশ কয়েক বার বেল বাজার পরে পূজা দরজা খুলেই ‘কাকিমা, মাকে বাঁচাও’ বলে আর্তনাদ করে ওঠে। রক্তাক্ত অবস্থায় ওই কিশোরীই ফ্ল্যাটের কোল্যাপসিব্‌ল গেটের তালা খুলে দিলে কাননদেবীরা ভিতরে ঢোকেন। পুলিশকে ওই প্রৌঢ়া জানান, রান্নাঘরের সামনে তখন দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন রশ্মি। গা ভর্তি রক্ত। কিছুটা তফাতে আর একটি ঘরের বারান্দার দরজায় ঠেস দিয়ে বসে ছিলেন বিকাশ। তাঁরও শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। পাশেই পড়েছিল একটি রক্তমাখা ছুরি।

কাননদেবীদের চেঁচামেচিতে বেরিয়ে আসেন আর এক প্রতিবেশী রানি কৌর। সকলেই বিকাশকে জিজ্ঞাসা করতে থাকেন, ‘কী হয়েছে? কেন এমন কাণ্ড ঘটালেন?’ কোনও উত্তর দিতে পারেননি ওই ব্যবসায়ী। পূজারও ঘাড়, হাত, পা থেকে রক্ত বেরোচ্ছিল। তবু কোনও মতে সে-ই মোবাইল থেকে মামার বাড়িতে ফোন করে কাননদেবীকে ধরিয়ে দেয়।

ফকির ঘোষ লেনের কাছেই মাতৃমন্দির লেনে রশ্মির বাপের বাড়ি। ফোনে তাঁর দাদা রাজেশ বর্মণকে পুরো বিষয়টি জানান কাননদেবী। খবর পেয়ে ছুটে আসেন রাজেশরা। রশ্মি ও পূজাকে নিয়ে তাঁরা আর জি কর হাসপাতালে চলে যান। এর পরেই পুলিশ এসে বিকাশকে বরাহনগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। পুলিশ জানায়, আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসকেরা রশ্মিকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। তাঁর শরীরের বিভিন্ন অংশের পাশাপাশি দুই পায়েও গভীর ক্ষত হয়েছিল। পূজাকে পরে বিটি রোডের ধারে এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বিকাশের অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকেও আর জি করে স্থানান্থরিত করা হয়েছে।

পুলিশ সূত্রের খবর, রশ্মিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি তাঁর দাদাদের শুধু বলতে পেরেছিলেন, ‘আমি বাঁচব না। সবাইকে মেরে দাও। আর কোনও টেনশন থাকবে না।’ তবে প্রতিবেশীরা সকলেই জানাচ্ছেন, কোনও দিনই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি দেখেননি তাঁরা। রানি বলেন, ‘‘এক দিনও একটা আওয়াজও পাইনি।’’

বছর বারো আগে সালকিয়া বাঁধাঘাটের বাসিন্দা বিকাশের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল রশ্মির। তখন বাঁধাঘাটে দর্জির দোকান ছিল বিকাশের। এর পরে তাঁরা লেকটাউনে চলে যান। সেই সময়ে রশ্মির বাপের বাড়ির লোকেরাই বিকাশকে পার্ক স্ট্রিটে‌ একটি দোকানে চাকরি করে দিয়েছিলেন।

এ দিন বরাহনগর থানায় অভিযোগ দায়ের করতে গিয়ে রশ্মির বাবা বিনয় বর্মণ জানান, দু’বছর আগে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা করার জন্য তাঁর কাছে টাকা চেয়েছিলেন বিকাশ। কিন্তু তা দেননি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী বিনয়বাবু। তখন থেকেই শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল বিকাশের। রোজ সকালে স্বামী ও মেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরে বাপের বাড়িতে চলে যেতেন রশ্মি। পূজাও স্কুল থেকে ফিরে মামার বাড়িতে চলে যেত। রাতে সেখানেই খাওয়াদাওয়া সেরে মা-মেয়ে ফকির ঘোষ লেনে ফিরতেন। কিন্তু বিকাশ তাড়াতাড়ি ফিরলেও শ্বশুরবাড়ি যেতেন না বলে জানান বিনয়বাবু। তিনি বলেন, ‘‘টাকাপয়সার টানাটানি নিয়ে ওঁদের মধ্যে বোধহয় কোনও অশান্তি চলছিল। কিন্তু মেয়ে আমাকে কিছু জানায়নি।’’

পুলিশ জেনেছে, সোমবার রাতেও বাপের বাড়ি থেকে খাওয়াদাওয়া সেরে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন রশ্মি। রাত পর্যন্ত টিভি দেখে খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস ছিল বিকাশের। তাই তাঁর খাবার বাড়ি ফিরে বানাবেন বলেই বাপের বাড়িতে জানিয়ে ছিলেন রশ্মি। এ দিন পূজা পুলিশকে জানায়, সে অন্য ঘরে ঘুমিয়ে ছিল। বাবা-মা’র চেঁচামেচি শুনে ঘুম থেকে উঠে সে দেখে, বিকাশ ছুরি দিয়ে রশ্মির সারা গায়ে কোপ মারছেন। বাধা দিতে গেলে বাবা তাঁকেও আঘাত করেন বলে পুলিশকে জানিয়েছে পূজা। এর পরেই সে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।

ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের এক কর্তা বলেন, ‘‘রশ্মির বাপের বাড়ির লোকেরা খুনের অভিযোগ করেছেন। তদন্ত চলছে।’’

Man Stabbed wife and daughter wife dead
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy