ঐতিহ্য: স্মৃতি বিজড়িত মার্বেল প্যালেসের সামনের রাস্তা। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
সমুদ্র-দেবতা নেপচুনের মূর্তি শোভিত ফোয়ারাটা দেখা যায় না বাইরে থেকে। তবে চোখে পড়বে ফোর সিজনস-এর ভাস্কর্য। ফোয়ারা ঘিরে সাবেক ইউরোপীয় শৈলীর শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম, হেমন্তের প্রতিরূপ। এখন শুধু পালা-পার্বণে জলের ধারা চুঁইয়ে পড়ে।
চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের রাম মন্দির তল্লাটের উল্টো ফুটে মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের অংশটি জুড়ে দু’টি কলকাতার হাত ধরাধরি। শাড়ির দোকান, রুপোর দোকান, বাসনের দোকানের সমকালীন কলকাতার ভিড়ে বিক্ষিপ্ত দ্বীপের মতো সাবেক নগরীর সুঘ্রাণ। লোহার ফটক পেরিয়ে ধ্রুপদী গোলাকার করিন্থিয়ান স্তম্ভ বিশিষ্ট দালান। জাফরি-কাটা বারান্দার প্রাসাদ-চত্বর জুড়েই অন্য জগৎ। রাজা রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়ি মার্বেল প্যালেসের অফিসঘরে কাঠের ঝাড়বাতির দিকে চোখ পড়লে বিস্ময়ে মুখে কথা সরে না। দেওয়ালে হাডসনের দেড়শো বছর আগের তৈলচিত্র কিংবা প্লাস্টার অব প্যারিসে বাড়ির প্রাণপুরুষের চোখে চোখ পড়লেও আজকের কলকাতা মুহূর্তে অবান্তর। সেই ১৮৩৫ সালে রাজেন মল্লিকের তৈরি ট্রাস্টের দায়দায়িত্ব সামলানোই এখনও এ বাড়ির উত্তরপুরুষদের জীবনের একমাত্র মন্ত্র— অন্যতম অছি হীরেন মল্লিক নিজেই হেসে মনে করালেন।
অফিসঘরের বাইরের ঠাকুর দালানময় প্রাক্-খ্রিষ্টীয় দেবদেবীদের ভিড়। ঠাকুর বসার চালচিত্রে রোমানদের বনদেবী ডায়ানার পৌরাণিক গল্পের ম্যুরাল। দু’ধারেও রামায়ণ ও গ্রিক পুরাণের মিশেল। শূর্পনখা ও লক্ষ্মণের পাশেই অ্যাপলো ও ডায়ানা। চৈত্রের কোনও পুণ্যদিনে, এই দেশি-বিদেশি পুরাণ কাহিনির চরিত্রদের ভিড় করা ঠাকুরদালানেই পুজো পান মল্লিকবাড়ির গৃহদেবতা জগন্নাথদেব। সরস্বতী পুজো, কালীপুজোও এখানেই হয়। আর দুর্গা পুজোর সময়ে ঠাকুরদালানের বেদীতে বসেই নিরন্তর চণ্ডী পাঠ। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের এই মিশেলটুকুই মল্লিক-বাড়ির সাংস্কৃতিক পরম্পরা।
তবে এমন চোখধাঁধানো ঠাকুরদালানে সেই উত্তমকুমার যুগের পরে শ্যুটিং-টুটিংয়ের হাঙ্গামা পুরো বন্ধ। শেষ ‘বই’ হয়েছিল রঞ্জিত মল্লিকের ‘স্বয়ংসিদ্ধা’। উটকো ভিড়ের উৎপাত খানিক কমেছে মার্বেল প্যালেসে আগন্তুকদের আসা-যাওয়া সরকারি অনুমতি নির্ভর হওয়ার পরেও। এখন ঢুকতে গেলে, কেন্দ্র বা রাজ্যের পর্যটন দফতরের ছাড়পত্র থাকা চাই। মার্বেল প্যালেসের চিড়িয়াখানা, পক্ষীশালার আকর্ষণ তাতে ফিকে হয়নি।
ভিতরের বাগানেই রবীন্দ্র-জয়ন্তীর ১২৫ বছরে গান ধরেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এই বর্ষার সবুজ ঘাসের চাদর জুড়ে তাতে থোকা থোকা লিলির নকশা। ইতিউতি ছড়ানো ১০০ বছরের বুড়ো গাছগাছালির মাঝে হ্যালোকোনিয়া, ব্রাউনিয়া, ক্যানন বল, অর্কিডদের সমাবেশ। চিড়িয়াখানায় চাকা-লাগানো কিছু হেরিটেজ খাঁচা ছাড়াও সাদা-কালো ধনেশ, কত রকমের হরিণ, গোলাপি পেলিক্যান, দৈত্যাকার কাঠবেড়ালির মতো আবাসিকদের ভিড়। ঠাকুরদালানে মল্লিকবাড়ির ম্যাকাও, কাকাতুয়া, রকমারি টিয়াদের সঙ্গে শিস দিয়ে খোশগল্প করেন কত্তাবাবুরা। খাঁচার বাইরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় ঝিনুকের খোলে টলটলে জল। ফি-সকালে পক্ষিকুলের তাতে স্নানের আয়োজন। এই বাড়িতেই শিল্পরসিক রাজেন মল্লিকের আর্ট গ্যালারি। সিঁড়িতে ইতালীয় শিল্পী ফ্ল্যাগনেত্তি-র গ্যালিলিওর বিচারের ছবি, উপরে ডাচ শিল্পী রুবেনের আসল ছবি কিংবা সিলিং ছোঁয়া পেল্লায় সুদৃশ্য বেলজিয়ান আয়না।
কবেকার কলকাতার এই ছোঁয়াচটুকু বেঁচে আছে কাছেপিঠে সিংহবাহিনী মল্লিক-পরিবার, কালীপ্রসন্ন সিংহ, রাম শীলদের বাড়ির সাবেক খিলান, ভাঙাচোরা দালানকোঠা জুড়েও। তবে মার্বেল প্যালেসে রাজেন মল্লিকের যাবতীয় শখ-আহ্লাদ, শিল্পসংস্কৃতি চর্চা, ধর্মকর্ম, রোজকার দরিদ্রনারায়ণ সেবা, সবই এখনও অটুট। উনিশ শতকের অভিজাত বাঙালির জীবন-দর্শন এখনও জ্যান্ত হট্টগোলময় ঘিঞ্জি উত্তর কলকাতার কোণটিতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy