Advertisement
E-Paper

মাছ-আনাজের সঙ্গেই বিকোল বিভ্রান্তি

বিশৃঙ্খলা এবং ধন্দের চরমে পৌঁছেছে শহরের কেনাবেচা। কোথাও মাছ বিক্রেতা ৫০০ টাকার নোট নিচ্ছেন, কোথাও ক্রেতা ১০০ টাকা দিতে না পারায়মাছ ওজন করেও থলিতে উঠছে না। সব্জি বিক্রেতারা অবশ্য কোথাও ৫০০ টাকা নিচ্ছেন না। পাইকারি আর খুচরো বাজারের চিত্রটা একই।বুধবার সকালে কলকাতার বিভিন্ন খুচরো, পাইকারি এবং মাছের বাজার ঘুরে এমনই অভিজ্ঞতা হয়েছে আনন্দবাজারের প্রতিবেদকদের।গড়িয়াহাট বাজারে গিয়ে বিপদে পড়েছেন খোকন সরকার। সব্জি কেনার পরে দোকানদারকে ৫০০ টাকার নোট দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দোকানি তা নেননি। সব্জিওয়ালা মুকেশ অগ্রবালের সাফাই, ‘‘পাঁচশো টাকা আর হাজার টাকার নোট কোলে মার্কেটের পাইকারি বিক্রেতা এবং চাষিরা নিচ্ছেন না।

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৪৭
লেনদেন প্রায় পুরোটাই নগদ টাকা নির্ভর। পোস্তায় তাই এ দিন যেন অঘোষিত ছুটি।

লেনদেন প্রায় পুরোটাই নগদ টাকা নির্ভর। পোস্তায় তাই এ দিন যেন অঘোষিত ছুটি।

গড়িয়াহাট বাজারে গিয়ে বিপদে পড়েছেন খোকন সরকার। সব্জি কেনার পরে দোকানদারকে ৫০০ টাকার নোট দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দোকানি তা নেননি। সব্জিওয়ালা মুকেশ অগ্রবালের সাফাই, ‘‘পাঁচশো টাকা আর হাজার টাকার নোট কোলে মার্কেটের পাইকারি বিক্রেতা এবং চাষিরা নিচ্ছেন না। তাই আমরাও নিতে পারব না।’’

আর এক ক্রেতা বাবুল দে পাঁচশো টাকা দিয়েছিলেন মাছ বিক্রেতা মুক্ত মণ্ডলকে। মুক্তবাবু পাঁচশো টাকার নোটটা ফিরিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘‘সাহেব পরে দেবেন।’’ তাঁর যুক্তি, ‘‘বাবুদের বাকিতে বিক্রি করলে ক্ষতি নেই। এঁরা প্রত্যেকেই দাম মিটিয়ে দেবেন পরে। তাঁদের পয়সা পেলে আড়তদারকে পয়সা দেব।’’

সল্টলেক

সল্টলেকের এ ই ব্লকের বাজারে মাছ বিক্রি করেন শ্রীদাম এবং কার্তিক। এ দিন মাছ কিনতে যাওয়ায় তাঁরা দু’জনেই বললেন, ‘‘দাদা মাছ নিয়ে যান। পয়সা পরে দেবেন।’’ কেন? খুচরো দিতে পারবেন না? শ্রীদাম বললেন, ‘‘পাঁচশো টাকার মাছ নিন, না হলে তিনশো টাকার উপরে মাছ কিনলে পাঁচশো টাকা ভাঙিয়ে দেব।’’ কেননা পঞ্চাশ, একশো টাকার নোট বেশি নেই। কার্তিক বললেন, পয়সা পরে দেবেন। ফাল্গুনী বাজারের দিলীপ বর মূলত রুই-কাতলার বিক্রেতা। অন্য দিনের মতো এ দিনও ৫০০-১০০০ টাকার নোট নিয়েছেন তিনি। বৈশাখী বাজারের মাছ বিক্রেতা সমীর প্রামাণিক চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ কিলোগ্রাম জ্যান্ত মাছ প্রতিদিন বিক্রি করেন। এ দিন কিন্তু তিনি তেমন ক্রেতা পাননি। বললেন, ‘‘খুচরো ১০০ টাকার নোট নেই। তাই বেশি বিক্রি করতে পারছি না।’’

লেক গার্ডেন্স

লেক গার্ডেন্স সুপার মার্কেটের অনেক দোকানদারই এ দিন ৫০০ এবং ১০০০ টাকা নিয়েছেন। মাছের ব্যবসায়ীরাও নিচ্ছেন ৫০০ কিংবা ১০০০ টাকা। তাঁদের বক্তব্য, এই টাকা মার যাবে না। দিন দু’য়েক পরে ব্যাঙ্কে গিয়ে তাঁরা সমপরিমাণ টাকা পেয়ে যাবেন। শুধু শুধু ব্যবসা বন্ধ রাখতে চান না তাঁরা।

বেহালা-সোদপুর

ছোট বাজার, সকাল সাতটা। দোকানে পৌঁছেই খদ্দেরদের প্রাথমিক প্রশ্ন, ‘‘ভাঙানি হবে তো দাদা?’’ মাছের দোকান থেকে ইতিবাচক উত্তর মিললেও ফিরিয়ে দিচ্ছেন বেশির ভাগ সব্জি বিক্রেতা। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘আড়তদারেরা না নিলে আমরা কী করে নেব? ছোট মুরগির দোকানে তো হাতে-লেখা পোস্টার সেঁটে দিয়েছেন বিক্রেতা, ‘‘পাঁচশো বা হাজারের নোট নেওয়া হচ্ছে না।’’

গড়িয়াহাটের মাছ বাজারে ৫০০ টাকার নোট নিয়ে বিপাকে ক্রেতা-বিক্রেতা দু’জনেই। বুধবার।

— স্বাতী চক্রবর্তী ও রণজিৎ নন্দী

লেক মার্কেট

সকাল সাড়ে আটটা। অন্য দিনের চেয়ে একটু ফাঁকাই লেক মার্কেটের মাছ বাজার। মাছের স্তূপ সাজিয়ে বসে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ক্রেতারা আসছেন, চোখে-মুখে সংশয়। একই সংশয়ের ছাপ বিক্রেতার চোখেও। কিন্তু সংশয় নিয়েই হাতে হাতে বদলাচ্ছে পাঁচশো-হাজারের নোট। মাছ বিক্রেতা তপন সাহা বঁটিতে প্রথম কোপটা বসিয়ে বললেন, ‘‘এত মাছ তো ফেলে দিতে পারি না!’’ মুদির দোকানি গৌতম দাস বলেন, ‘‘বড় নোট নেব না। বেশির ভাগই নিয়মিত খদ্দের, তাই ধারে জিনিস দিচ্ছি। নোট-সমস্যা মিটলে পেমেন্ট নেব।’’

কোলে মার্কেট

বেলা সাড়ে এগারোটা। অন্য দিন এ সময়ে পা দেওয়া যায় না সেখানে। এ দিন ফাঁকা বাজারে মাথায় হাত ব্যবসায়ীদের। এক বাক্যে সকলেই জানালেন, কয়েক হাজার টাকার নীচে কেনাবেচা হয় না এখানে। সকলেই আসেন বড় নোট নিয়ে। ‘‘কী করব, জানি না। আমাদের কার্ড নেই। বড় নোট না নিলে কয়েক কোটি টাকার সব্জি পচে স্রেফ নষ্ট হয়ে যাবে। আবার নিয়ে নিলেও বিপদ। ব্যবসা বন্ধ করে ব্যাঙ্কে লাইন দেওয়া সম্ভব নয়। প্রতি দিন চার হাজার শুনছি। কত দিন ধরে টাকা বদলাব,’’ বিশাল ঝুড়ি ভর্তি গাজরের উপরে জল ছেটাতে ছেটাতে বললেন রহিম মোল্লা।

বৈঠকখানা বাজার

বৈঠকখানা বাজারে পাইকারি মুদি-সামগ্রী বেচাকেনা চলে। এই বাজারের দোকান-মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সচিব স্মরজিৎ রায় জানালেন, উপায় নেই তাই বড়় নোট নিতেই হচ্ছে, আড়তে দিতেও হচ্ছে। নিষিদ্ধ জানার পরেও লেনদেন চলছে বাধ্য হয়ে। কাল রাতের ঘোষণার পরে সামগ্রিক ভাবে কেনাবেচা একটু পড়ে গিয়েছে বলে জানালেন তিনি। তাঁর আশঙ্কা, ‘‘জেনে বা না জেনে সব মিলিয়ে কাজ চলে যাচ্ছে আজ। কিন্তু সকলে জানার পরে বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে। এত সাধারণ মানুষ ব্যাঙ্কে গিয়ে অল্প অল্প করে টাকা বদলাবেন। ভিড় সামলানো যাবে তো?’’

দমদম

বুধবার সকালে দমদম-সহ নাগেরবাজার, গোরাবাজার, এইচএমভি বাজার ঘুরে দেখা গেল, সর্বত্রই প্রায় মাছি তাড়ানোর অবস্থা। মাছের বাজার ফাঁকা। সব্জি বাজারেও ক্রেতা কম। কেন? বিক্রেতারা বলছেন, খুচরোর আকাল। অনেকের কাছেই ৫০০ টাকার নোট। সব্জি বাজারের অবস্থা করুণ। চাষিদের কাছে বড় নোট ভাঙিয়ে দেওয়ার মতো টাকা নেই। ফলে যারা পকেটে করে ৫০-১০০ টাকার নোট নিয়ে আসছেন, তাঁরাই সব্জি কিনে ফিরছেন। গোরাবাজারের মাছ বাজারে দেখা গেল, ক্রেতাদের ৫০০-র নোট ভাঙিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

বাঘা যতীন বাজার

মাছ বাজারে দিব্য চলছে বড় নোট। না চললে অসুবিধা ক্রেতা-বিক্রেতা দু’পক্ষেরই। তাই কোনও রকম বচসায় না গিয়ে ক্রেতাদের থেকে হাজার বা পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে নিচ্ছেন মাছ ব্যবসায়ীরা। এই সুযোগেই একাধিক পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন দোকান থেকে মাছ কিনে টাকা ভাঙিয়ে নিচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই।

মানিকতলা

১০০ টাকার মাছ কিনে ৫০০ টাকার নোট বাড়িয়ে দিলেন ক্রেতা। বিক্রেতা স্বপন হালদারও ছাড়ার পাত্র নন। কিছুতেই নেবেন না। তাঁর কথায়, ‘‘আরে অন্তত ৩০০-৪০০ টাকার মাছ না নিলে আমি কেন ৫০০ টাকা ভাঙাব?’’ তবে দীর্ঘ দিনের মুখ চেনা ক্রেতা-বিক্রেতার। এমনই এক ক্রেতা গৌতম ভৌমিক ৫০০ টাকা দিয়ে বিক্রেতাকে আশ্বস্ত করে গেলেন, ‘‘না চললে আমাকে ফেরত দিয়ে দেবেন। চিন্তার কোনও কারণ নেই।’’ বাজার ব্যবসায়ীদের নেতা বাবলু দাসের কথায়, ‘‘যতক্ষণ সঙ্গে খুচরো আছে, ততক্ষণ ৫০০-১০০০ নিতে থাকব। কিছু পরিচিত ক্রেতাকে ধারেও মাছ দিচ্ছি।’’ কেউ ৫০০ টাকা দিয়ে ২০০ টাকার মাছ কিনলে, বকেয়ার খাতায় বাকি ৩০০ টাকা লেখা হয়ে থাকছে। তবে এতটা সাহস দেখাননি আলু বিক্রেতা রামচন্দ্র সাউ। নিজের অ্যাকাউন্ট রয়েছে ঠিকই। তবু সংশয়, ‘‘ব্যাঙ্ক যদি না নেয়, তখন?’’

পোস্তা

সকাল থেকেই ঘনঘন ফোন পোস্তার বাজারে। একটাই প্রশ্ন, ‘‘পাঁচশো, হাজারের নোট নিয়ে যাব তো?’’ অনেকে পুরনো নোটের বদলে বিক্রিবাটা সেরেছেন। আবার কোনও কোনও বিক্রেতা পুরনো নোট না নেওয়ায় হয়রানি বেড়েছে ক্রেতাদের। অতিরিক্ত ১০০ টাকা দিয়ে ৫০ কেজি চিনির অর্ডার দিলেন নন্দ্রীগ্রামের রতন মণ্ডল। তাঁর কথায়, ‘‘নিয়মিত যে দোকান থেকে কিনি, সেখানে বড় নোট নিল না। বাধ্য হয়ে অন্য দোকানে বেশি টাকা গুনতে হল।’’

আলু, পেঁয়াজের পাইকারি বাজারে পুরনো নোটে জিনিস কিনছেন ক্রেতারা। দীর্ঘ দিনের ধার মেটাতে বড় নোট নিয়ে সাত সকালেই হাজির অনেকে ক্রেতা। তাঁদের হতাশ করেননি বিক্রেতারা। ব্যবসায়ীদের কথায়, ‘‘পুরনো নোট ফেরাতে ৫০ দিন সময় আছে তো।’’

হাওড়া পাইকারিমাছ বাজার

খুচরো বিক্রেতাদের থেকে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট না নিতে পারায় বুধাবার প্রায় ৫০ শতাংশ মাছ পড়েই রইল। যা বিক্রি হয়েছে, তা-ও ধারে। বিক্রেতারা জানান, অন্য দিনের তুলনায় বাজারে লক্ষ লক্ষ টাকার ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট উড়ে বেড়িয়েছে। কারণ যাঁরা ধারে মাছ নিয়ে গিয়ে ব্যবসা করেন, তাঁরা মূলত শনিবার ও সোমবার টাকা দেন। কিন্তু এ দিন দেখা গিয়েছে, ওই ব্যবসায়ীরাই লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে ঘুরছেন ধার মেটানোর জন্য। সবই ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট হওয়ায় তা নিতে সরাসরি অস্বীকার করেছেন আড়তদারেরা। হাওড়া হোলসেল ফিশ মার্কেট স্টল ওনারস কোআপারেটিভ সোসাইটির সম্পাদক সৈয়দ আনোয়ার মাকসুদ বলেন, ‘‘বাজারের অবস্থা এক দিনেই খারাপ হয়ে গিয়েছে। যাঁদের থেকে আমরা মাছ কিনছি, তাঁরা টাকা নিচ্ছেন না। আবার যাঁকে মাছ বিক্রি করছি, তাঁরাও টাকা দিলে নিতে পারছি না। ফলে মাছ বাজারেই পড়ে থাকছে।’’ ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, এমন চললে মাছ ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হবে। তবে লাভবান হবেন ক্রেতারা। কারণ, বরফ কিনতে অনেক খরচ। তার থেকে কম দামে মাছ বিক্রি করে দেওয়াই সহজ।

পাতিপুকুর মাছের আড়ত

মিনাখাঁর বিদ্যুৎ মণ্ডল ভোর তিনটের সময়ে ম্যাটাডর থেকে মাছ নামিয়ে বললেন, ‘‘৫০০-১০০০ ছাড়া ব্যবসা চলবে নাকি!’’ এখানে প্রতি দিন কোটি টাকার লেনদেন হয় বলে জানালেন ব্যবসায়ী সংগঠনের সভাপতি কমল দাস। তার ৮০ শতাংশ ধারে, বাকি নগদে।

কমলবাবুর কথায়, ‘‘কিন্তু, আগের ধার তো আজও শুধতে হচ্ছে। তবে না টাকা রোল করবে।’’ অন্ধ্র-সহ বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চেক মারফত লেনদেন হলেও বেশির ভাগ লেনদেনই হয় নগদ টাকায়। এ দিনও হল। দিব্যি ঘোরাঘুরি করল ৫০০-১০০০ নোট। তা নিয়ে কখনও কখনও অবশ্য সামান্য বচসাও হল।

Market Currency note Money
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy