Advertisement
E-Paper

জীর্ণ কিছুই নেই, ওঁদের শুরুও তাই বেলাশেষে

বছর দশেক আগেও এক জন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতেন তিনি কখন বাড়ি ফিরবেন সেই আশায়। কিন্তু স্ত্রী প্রয়াত হওয়ার পরে কেউ খবরও রাখে না, তিনি বাড়িতে আছেন না অন্য কোথাও চলে গিয়েছেন।

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৬ ০১:১৫
পছন্দের সঙ্গী। বৃহস্পতিবার। — শুভাশিস ভট্টাচার্য।

পছন্দের সঙ্গী। বৃহস্পতিবার। — শুভাশিস ভট্টাচার্য।

বছর দশেক আগেও এক জন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতেন তিনি কখন বাড়ি ফিরবেন সেই আশায়। কিন্তু স্ত্রী প্রয়াত হওয়ার পরে কেউ খবরও রাখে না, তিনি বাড়িতে আছেন না অন্য কোথাও চলে গিয়েছেন।

ছেলে-মেয়েরা তাদের মতো করে সংসার গুছিয়ে নিয়েছে। শ্রীরামপুরের তিনতলা বাড়িটায় একা থাকতে থাকতে মনটা হাঁফিয়ে উঠেছিল ৮৩ বছরের নিমাই সাধুর। খুব ইচ্ছে করত মানুষের গলা শোনার।

জীবনে অনেকটা পথ একা হেঁটেছেন। এখন বার্ধক্যে পৌঁছে প্রতি দিনের ভাল লাগা-মন্দ লাগার গল্পগুলো বড্ড বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু শুনবে কে? চারপাশের মানুষজন ভীষণ ব্যস্ত। অন্যের কথা শোনার মতো সময় তাঁদের কোথায়? অবসরপ্রাপ্ত সিভিল কন্ট্র্যাক্টর নিমাইবাবু তাই চেয়েছিলেন পছন্দের সঙ্গী খুঁজে নিতে। সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে সেই কাজ শুরু করলেন তিনি।

মেয়ের সঙ্গেই বিলেতে বাকি জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন দেবী ঘোষ। কিন্তু সে দেশে নাকি মা-বাবাকে রাখার অনেক সমস্যা। সে কথা জানিয়ে মেয়ে ৮৪ বছরের মাকে নিয়ে গেলেও, কয়েক বছরের মধ্যে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। একটি হোমে রাখার ব্যবস্থা করেছেন মাকে। নাতনি দু’টোকে ছেড়ে আসার সময়ে বারবার বৃদ্ধার মনে হয়েছিল, ওদের সঙ্গে কাটাতে পারার মধ্যেই জীবনের সব সুখ। দেশে ফিরে যখন হোমে থাকতে শুরু করলেন, মাঝে মধ্যেই মনে উঁকি দিচ্ছিল অতীতের নানা অভিজ্ঞতা। ভাবছিলেন, জীবনে না পাওয়ার দুঃখ তো ছিল বরাবরই। কিন্তু ঘরকন্নার ব্যস্ততায় সেই যন্ত্রণাগুলো ঢেউয়ের মতো কখন যেন হারিয়ে গিয়েছে। তাই ফের সংসার পাতলে মন্দ কি?

হোমের চিকিৎসককে বৃদ্ধা জানালেন তাঁর মনের কথা। চিকিৎসক বললেন, এই অনুভূতির মধ্যে অস্বাভাবিকতা নেই। তাঁর মতো অনেকেই নতুন ভাবে পথ চলা শুরুর কথা ভাবছেন। এ দিন ওই বৃদ্ধা খুঁজে পেয়েছেন সম মনস্ক এক মানুষকে, জীবন সায়াহ্নে এসে যাঁর হাত ধরে তিনি হাঁটতে পারবেন, এই বিশ্বাস তাঁর হয়েছে। তিনি বছর ৯২-র রতীশ ভট্টাচার্য। তবে তাঁকে বিয়ে করবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত এখনও নেননি বৃদ্ধা। তিনি শুধু আশা করছেন, ভাল লাগার মানুষটার সঙ্গে আরও কয়েক বার দেখা করে ভাব জমলে সেই সিদ্ধান্ত নিতেও হয়তো অসুবিধা হবে না।

এমনই কিছু প্রবীণ মানুষদের নিয়ে বৃহস্পতিবার স্পোর্টস জার্নালিস্টস ক্লাবে ‘ম্যাট্রিমনিয়াল মিট’-এর আয়োজন করেছিল একটি সংস্থা। তবে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা সবাই যে বিয়ে করতে আগ্রহী, এমনটা নয়। ‘পাত্র-পাত্রী’র তালিকায় অনেকেই ছিলেন যাঁরা খুঁজে নিতে চান সঙ্গীকে। জানালেন, তাঁরা যে আবার নতুন জীবন শুরু করতে পারেন, সেই জোর তাঁরা পাচ্ছেন পূর্ণেন্দু মিত্র ও মাধবী মিত্রকে দেখে।

বছর ৬৫-র পূর্ণেন্দুবাবু কয়েক মাস আগে বিয়ে করেছেন বছর পঞ্চাশের মাধবীদেবীকে। তাঁরা উপলব্ধি করেছেন, বার্ধক্যের সমস্যা ভাগ করে না নিলে তা আরও চেপে বসতে চায়। দু’দশক আগে স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে যখন আবার বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পূর্ণেন্দুবাবু, তখন পাশে পেয়েছিলেন এই সংস্থার সদস্যদের। তাঁরা তাঁর জীবনসঙ্গীকে খুঁজতে সাহায্য করেছিলেন। পূর্ণেন্দুবাবুর কথায়, ‘‘অনেক কিছু বলতে চাইছিলাম। কিন্তু শোনার কেউ ছিল না। পাশে কেউ না থাকলে আরও বেশি অসহায় লাগে। নতুন ভাবে জীবন শুরু করার কোনও বয়স থাকে না। এই জীবনে ভাল থাকার অধিকার সকলেরই আছে।’’

এ দিনের অনুষ্ঠানের আয়োজক, চিকিৎসক অমিতাভ দে সরকার বলেন, ‘‘মুম্বই, আমদাবাদ থেকেও কলকাতার প্রবীণ মানুষেরা আরও উৎসাহের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবে এগিয়ে এসেছেন। আসলে কেউ জীবনে একা থাকতে চান না। একাকিত্ব দূর করতেই সঙ্গীর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।’’

জেরেন্টোলজিস্ট-চিকিৎসক ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘এ দেশে প্রবীণদের বিয়ে ব্যাপারটি অপেক্ষাকৃত নতুন হলেও বিদেশে এর প্রচলন আছে। বয়স হলেই কিন্তু প্রেম, ভালবাসার অনুভূতিগুলো চলে যায় না। কিন্তু সমাজের চোখরাঙানির কাছে অনেকেই তা লুকিয়ে রাখেন। বিয়ের জন্য বয়সের কোনও সীমারেখা থাকে না। বৈজ্ঞানিক ভাবে এটা প্রমাণিত, ভালবাসার মানুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক জীবনযাপনের গুণমান বাড়ায়।’’

জীবন-সায়াহ্নে এসে নতুন জীবন শুরু করার চাহিদাকে দু’ভাবে বিশ্লেষণ করছেন মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল। তাঁর কথায়, ‘‘প্রবীণ হয়েও মন সক্রিয় আছে, নতুন মানুষকে জীবনে এনে তাঁরা আরও সমৃদ্ধ হতে চাইছেন এটা ইতিবাচক দিক। আবার যে বয়সে জীবনের উপলব্ধি দরকার, গভীরে চিন্তা করা দরকার, তখন আবার নতুন ভাবে পথ চলার অর্থ তাঁর মন ভোগবাদী। এটা নেতিবাচক।’’

Matrimonial meets elderly citizens
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy