E-Paper

শোকের দাহ সম্পন্ন ডোমেদের ‘খুশি’র টাকায়!

চুল্লিতে ঢোকানো থেকে চিতাভস্ম পাওয়া, প্রতি পদে টাকা দাবি শ্মশানে। সরেজমিনে দেখা হল বাস্তব পরিস্থিতি।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৭:৩২

—ফাইল চিত্র।

বাইরে প্রবল বৃষ্টি। ভিতরে সব ক’টি চুল্লিই তখন ফাঁকা। কেওড়াতলা শ্মশানের মূল ভবনের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অংশে তখন মাটিতে গোল হয়ে বসে তাস খেলা চলছে। মৃতের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কাগজ কোথায় তৈরি করাতে হবে? মরদেহই বা কোথায় নামাতে হবে? তাস খেলায় ব্যস্ত যুবক মাথা না তুলেই বললেন, ‘‘আমরাই সব করে দেব। শুধু আমাদের দিকটা দেখে দেবেন।’’ তাস খেলায় ব্যস্ত বাকিদের মধ্যে হাসির রোল উঠল। আপনারা কারা? উত্তর এল, ‘‘ডোম। আমাদের খুশি না করলে দেহ পুড়বেই না!’’

যেখানে কথা হচ্ছে, তার পাশেই দেওয়াল জুড়ে স্থানীয় ৮৮ নম্বর ওয়ার্ডের পুরপ্রতিনিধি তথা সাংসদ মালা রায়ের নামে বিশাল হোর্ডিং। তাতে লেখা, ‘কলকাতা পুরসভা কর্তৃক নির্ধারিত মূল্য ছাড়া কোনও অতিরিক্ত টাকা কাউকে দেবেন না’। তা হলে? ডোম বললেন, ‘‘ও রকম লেখা থাকে অনেক কিছু।’’

নিমতলা ঘাট শ্মশানে মরদেহ নামানো থেকে চিতাভস্ম হাতে পাওয়া পর্যন্ত প্রতি পদে টাকা চাওয়ার মতো ঘটনা কি এখানেও? দেখা গেল, কেওড়াতলা শ্মশানেও প্রতি পদে দাবি করা হচ্ছে টাকা। অথচ, শ্মশানের কাছেই কালীঘাট চত্বরে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি-সহ ‘সমব্যথী’ প্রকল্পের হোর্ডিং। যেখানে দুঃস্থ মৃতের আত্মীয়দের টাকা দিয়ে সাহায্য করার কথা বলা হয়েছে। এক ভুক্তভোগী পরিজন বললেন, ‘‘হোর্ডিং আছে, নজরদারি কই?’’

মৃতের আত্মীয়ের সঙ্গে এর পরে যাওয়া হয়েছিল শ্মশানের অফিসঘরে। ফর্ম পূরণ করে জমা করার পরে বলা হল, ‘‘আমাদের কিছু দিয়ে যাবেন না?’’ আলাদা টাকা দিতে হবে নাকি? আত্মীয়ের প্রশ্নের উত্তরে পুরকর্মীর মন্তব্য, ‘‘অন্তত পাঁচশো দিন। না হলে ডেথ সার্টিফিকেট আটকে থাকবে।’’

শেষকৃত্যের সরঞ্জাম নেওয়ার ঘরের কাছে যেতেই নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে জিনিসপত্র হাতে ধরিয়ে দিয়ে ভিতরে থাকা ব্যক্তি বললেন, ‘‘কিছু খরচ করুন!’’ এখানেও টাকা? চিতাভস্ম নেওয়ার সময়ের অভিজ্ঞতা আরও খারাপ। নিমতলার মতোই ঘিরে ধরল ডোমের দল। বলা হল, ‘‘খরচ করলে আমরাই সব গুছিয়ে মাটির হাঁড়িতে তুলে দেব। না হলে জানি না।’’ টাকা নেই জানাতে বলা হল, ‘‘নিজেরাই চিতাভস্ম তুলে নিন।’’

দাদাগিরির অভিযোগে কেওড়াতলা শ্মশান উত্তপ্ত হয়েছিল খোদ সত্যজিৎ রায়ের শেষকৃত্যে। ১৯৯২ সালের ২৪ এপ্রিল। পুলিশ কেন ঢুকতে দিচ্ছে না, তা নিয়ে কেওড়াতলা শ্মশানে গিয়ে গন্ডগোল করেছিলেন স্বপন দে নামে এক যুবক। পুলিশের খাতায় ও সাধারণের মধ্যে ‘শ্মশান স্বপন’ নামেই তাঁর কুখ্যাতি। উপস্থিত তদানীন্তন মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তৎকালীন নগরপাল বীরেন সাহাকে বিষয়টি দেখতে বলেন। কিন্তু বীরেনকে দেখেই স্বপন চেঁচাতে শুরু করে বলেন, ‘‘সাহাদা দেখ, পুলিশ কী করছে!’’ পাড়ার মস্তানের মুখে নগরপালকে ‘সাহাদা’ সম্বোধন শুনে তাজ্জব হয়ে যান বুদ্ধবাবু। ঘটনাস্থল থেকেই গ্রেফতার করা হয় স্বপনকে। পদ হারাতে হয় বীরেন সাহাকেও।

পরে জানা যায়, কেওড়াতলাতেই দেহ নামিয়ে বালিশ, বিছানা আর খাট আলাদা করে রেখে দিতেন শ্মশানকর্মীরা। পরে খাট ফের বাজারে পাঠিয়ে দেওয়া হত। অন্য লরি বালিশ, চাদর নিয়ে গুদামে চলে যেত। খাটপিছু শ্মশানকর্মীরা পেতেন ১৫০ টাকা করে। সেই খাটই বিক্রি হত ৪০০ টাকায়। চক্রের দালালেরা নিত খাটপিছু ১০০ টাকা। তোশক, বালিশে নতুন কাপড়ের মোড়ক দিয়ে গুদাম থেকে তা যেত বাজারের বেডিং স্টোর্সে। বালিশ-তোশক বাবদ শ্মশানকর্মীরা পেতেন ১০০ টাকা করে। সিন্ডিকেটের মাথারা নিত ৫০ টাকা। অর্থাৎ, এক খাটেই বার বার মৃতদেহ যেত শ্মশানে। অন্য দিকে, মরদেহের বিছানা হয়তো বিক্রি হত কারও বাসর সাজাতে।

তেমন কোনও চক্র কি ফের সক্রিয়? স্থানীয় সাংসদ তথা পুরপ্রতিনিধি মালা বলেন, ‘‘এমন অভিযোগ কখনও শুনিনি। মৃতদেহ নামিয়ে দেওয়া বা অন্য কোনও কারণে কেউ হয়তো কিছু টাকা চেয়েছেন, কিন্তু জুলুমের প্রশ্ন নেই। তবে যিনি টাকা চান আর যিনি দেন— দু’পক্ষই সমান অপরাধী।’’

(শেষ)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

burning ghat KMC

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy