উদ্যাপন: রোশন (লাল জামা) ও বেবির (ডান দিকে) সঙ্গে সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরা অন্য রোগীরা। মঙ্গলবার, এসএসকেএমে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
পেরিয়েছে দশটি বছর। এসএসকেএম হাসপাতালে আট মাসের যে শিশু রোশন আলিকে দিয়ে রাজ্যে সে দিন লিভার প্রতিস্থাপনের সূচনা হয়েছিল, নতুন বছরের প্রথম দিনে তাকে দিয়েই শুরু হল নতুন প্রাণের ঘরে ফেরার তোড়জোড়। আগামী দিনে লড়াই কঠিন হলেও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকার অঙ্গীকার করলেন চিকিৎসকেরাও। মঙ্গলবার এসএসকেএম হাসপাতালের এসডিএলডি বিল্ডিং যেন সাক্ষী হয়ে রইল রোশন, সঞ্জিত বালা, চণ্ডীচরণ ঘোষ, উত্তম দ্বিবেদী, বেবি ঘোষ কিংবা জয়প্রতিম ঘোষেদের এক সুতোয় গাঁথা হয়ে লড়াইয়ের শপথ নেওয়ার সেই মুহূর্তের।
জ্বলন্ত মোমবাতিতে ফুঁ দিয়ে একসঙ্গে চকলেট কেক কাটল বর্ধমানের রোশন, ব্যারাকপুরের সঞ্জিতের শিশুপুত্র এবং লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি আরও এক খুদে। হাততালিতে ভেসে গেল এসডিএলডি বিল্ডিংয়ের সেমিনার হল। দর্শকের আসনে তখন লিভার প্রতিস্থাপনের পরে সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরা রোগী, তাঁদের পরিজন, চিকিৎসক, নার্স, বিভাগীয় কর্মীরা এবং এসএসকেএম-এর ডিরেক্টর মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায়, সুপার রঘুনাথ মিশ্র এবং ডেপুটি সুপার অতীন্দ্রনাথ মণ্ডল।
দীর্ঘ বাইশ দিন চিকিৎসার পরে এ দিন বাড়ি ফিরলেন বেবি। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় বারুইপুরের অটোচালক জয়প্রতিম। তাঁর শরীরে ডিসেম্বরের ২০ তারিখ বসেছে পথ দুর্ঘটনায় ব্রেন ডেথ হওয়া সজল করের লিভার। মা সন্ধ্যাদেবী বলেন, ‘‘নিখরচায় না হলে ছেলেটাকে বাঁচানো অসম্ভব ছিল। আমাদের কাছে ভগবান এই ডাক্তারবাবুরাই।’’
এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় চিকিৎসক ও কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করে মণিময়বাবু বলেন, ‘‘বিশাল কর্মযজ্ঞে সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতাও থাকবে। তাতে ভেঙে না পড়ে কোমর বেঁধে এগোতে হবে।’’ তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এসএসকেএমে গত দশ বছরে পনেরো জন রোগীর শরীরে লিভার প্রতিস্থাপন হয়েছে। ২০১৮ সালেই ছ’টি হয়েছে। তিনি জানান, পূর্ববর্তী বছরে কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও গত বছরের সাফল্য উদ্বুদ্ধ করছে চিকিৎসক ও কর্মীদের।
এ দিনের অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ছিল লাল জামা পরা ছটফটে রোশন। বাবা রজব আলির লিভারে যে নতুন জীবন পেয়েছে। বেবি বাদে অন্যরা প্রত্যেকেই ‘ক্যাডাভার ট্রান্সপ্লান্ট’ অর্থাৎ ব্রেন ডেথের পরে মৃতের অঙ্গগুলির মধ্যে লিভার প্রতিস্থাপনে নবজন্ম পেয়েছেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব উত্তম দ্বিবেদীর শরীরে গত বছর সপ্তমীতে প্রতিস্থাপিত হয় দুর্গা সাধুর লিভার। নদিয়ার তাহেরপুরের বাসিন্দা কৃষক চণ্ডীচরণ ঘোষ গত ২৩ অগস্ট ব্রেন ডেথ হওয়া রোগী অদিতি সিংহের লিভার পান। ব্যারাকপুরের বাসিন্দা সঞ্জিতের অস্ত্রোপচার হয় গত ১৯ নভেম্বর। বাঁকুড়ার বাসিন্দা তেরো বছরের কিশোরী মধুস্মিতা বায়েনের লিভার পান তিনি।
রাজ্যে এত দিন এসএসকেএম এবং অ্যাপোলো এই দুই হাসপাতালেরই লিভার প্রতিস্থাপনের অনুমতি ছিল। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর সম্প্রতি বাইপাসের রবীন্দ্রনাথ টেগোর ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়াক সায়েন্সেসকে এই লাইসেন্স দিয়েছে। যদিও এখনও কোনও অস্ত্রোপচার হয়নি। অ্যাপোলো হাসপাতাল সূত্রের খবর, ২০১৩ সাল থেকে সেখানে হচ্ছে লিভার
প্রতিস্থাপন। ১৭টির মধ্যে পাঁচটি ক্ষেত্রেই মৃতের লিভার নিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এসএসকেএম হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘‘গত তিন বছর ধরে ‘ক্যাডাভার ট্রান্সপ্লান্টে’র সংখ্যা বাড়ছে। যা চিকিৎসা ক্ষেত্রে ইতিবাচক। ফলে বহু সাধারণ মানুষের কাছে বিনামূল্যে চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়া যাবে। তাই ওঁদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।’’
অনুষ্ঠানে শেষে তখন ঘরে ফেরার পালা। সঞ্জিত জানান, মধুস্মিতার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চান তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘আমি চিরঋণী। সামনাসামনি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই ওঁদের।’’ গলা বুজে আসা সঞ্জিতের সঙ্গে তখন সহমত অন্যরাও। চেয়ারে বসিয়ে বেবিকে ধরাধরি করে নামাতে একে একে এগিয়ে গেলেন সবাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy