শ্রীহট্ট থেকে বুকে বুকে বেঁধে এনেছিলেন গান। নিয়ে এসেছিলেন কলকাতায়। সে সব গান এখন নানাকণ্ঠের শাখায়, প্রশাখায় নানা ভাবে প্রবাহিত। বাংলা লোকগানের বিবিধ বৈচিত্রের মধ্যে এক অনন্যসুন্দর ধারা। এই কলকাতার শ্রোতারা এখনও ঠিক খুঁজে নেন বর্তমানে ভিন্দেশীয় স্থান শ্রীহট্টের সেই সমৃদ্ধ সঙ্গীতকে। প্রথম যিনি বহন করে নিয়ে এসেছিলেন, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই রণেন রায়চৌধুরীর জন্মশতবর্ষ চলছে। সম্প্রতি তাঁকে স্মরণ করল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বাহিরানা’। দক্ষিণ কলকাতার যোধপুর পার্কে ‘রাগ অনুরাগ মিউজ়িক রিসার্চ সেন্টার’-এ আয়োজিত সারা দিনের এক অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে ছিল ‘শ্রমসঙ্গীত’ বিষয়ক এক কর্মশালা। দ্বিতীয় পর্বে হয় ‘ভাটি গাঙের নাইয়া’ শীর্ষক লোকসঙ্গীতানুষ্ঠান এবং গণসঙ্গীত।
কর্মশালাটি পরিচালনা করেন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার এবং লোকসঙ্গীত গবেষক জলি বাগচী। প্রায় ৩০ জন যোগ দেন শ্রমসঙ্গীতের এই কর্মশালায়। পবিত্র আলোকপাত করেন শ্রমসঙ্গীতের গুরুত্বের উপর। তাঁর কথায়, সঙ্গীত একটি বিনোদনের মাধ্যম হলেও এর মধ্যে শ্রমসঙ্গীত একটি আলাদা জায়গা দাবি করে। কারণ, শ্রমসঙ্গীতের মধ্যে শুধু বিনোদন থাকে না। তিনি বলেন, “শ্রমসঙ্গীত কোনও গীতিকারের লেখা নয়। খেটে খাওয়া মানুষের সুখ, দুঃখ, বেদনা, অবসাদ, আনন্দ, প্রতিবাদ থেকে উঠে আসা গান। তাই গানগুলির মধ্যে দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের যন্ত্রণা এবং উদ্যাপন সরাসরি উঠে আসে। এগুলি হল জীবন্ত দলিল।”
বাহিরানার অনুষ্ঠানে ‘গণবিষাণ’-এর সঙ্গীত পরিবেশন। —নিজস্ব চিত্র।
শ্রমসঙ্গীতের বর্ণনা দিতে গিয়ে পবিত্র বলেন, “যে মানুষ শ্রমদান করছেন, তাঁর সেই শ্রমের একঘেয়েমি কমাতে তিনি এক ধরনের গান গাইছেন। আবার শ্রমদান হয়ে যাওয়ার পরে যখন তিনি শ্রম নিয়েই গান করছেন, তখন তার গানের মধ্যে প্রেম-ভালবাসার কথাও উঠে আসছে।” তাঁর কথায়, শ্রমসঙ্গীতের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিভেদ ভুলে সম্প্রীতি এবং মিলনের কথা উঠে আসে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গানের কথা, বিষয়বস্তু বদলে গেলেও শ্রমজীবী মানুষের আকুতি-যন্ত্রণা একই রকম রয়ে গিয়েছে। তিনি বলেন, “শ্রমসঙ্গীতের মাধ্যমে প্রতিবাদ উঠে এসেছে, জোট বাঁধার কথা উঠে এসেছে। বিভেদ ভুলে সাম্যের কথা উঠে এসেছে। সবসময় প্রকট ভাবে না-হলেও শ্রমসঙ্গীতের মধ্যে নারীশ্রমের কথাও আলাদা করে উঠে এসেছে।”
সঙ্গীত পরিবেশন করছেন রণেন রায়চৌধুরীর কন্যা সঞ্চিতা রায়চৌধুরী। —নিজস্ব চিত্র।
এর পরে লোকসঙ্গীত গবেষক জলি দু’টি গান শেখান কর্মশালায়। তার মধ্যে একটি বিখ্যাত ইংরেজি গান ‘হুইচ সাইড আর ইউ অন’-এর বাংলা অনুবাদ ‘কোন দিক সাথী, কোন দিক বল’। অপরটি শিশুশ্রম বিরোধী গান ‘এই ছেলেটা ভেলভেলেটা’।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে লোকসঙ্গীত পরিবেশন করেন রণেন-কন্যা সঞ্চিতা রায়চৌধুরী। ঋত্বিক ঘটকের সিনেমায় গাওয়া রণেনের একাধিক বিখ্যাত গানও পরিবেশন করেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে ‘নামাজ আমার হইল না আদায়’ বা ‘কান্দিয়া আকুল হইলাম ভব নদীর পারে’-র মতো গানও। এর পর গণসঙ্গীত পরিবেশন করে অর্ধশতাব্দী ছুঁতে চলা দল ‘গণবিষাণ’। ‘পায়ের নীচে ফুঁসছে মাটি…’-সহ বেশ কয়েকটি গান পরিবেশন করে তারা। বাহিরানার পক্ষে গোটা অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন নন্দিতা বারিক এবং দেবকুমার সামন্ত।