কখনও উজ্জ্বল কখনও মলিন বাড়িগুলির মাঝে ইতস্তত সবুজের ছোঁয়া। ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট আর পরিচ্ছন্ন পরিবেশ এ পাড়ার স্বতন্ত্র চরিত্র। পাড়ার আনাচে কানাচে মিশে আছে কত স্মৃতি, কত অনুভূতি। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় এখানে কাটিয়ে উপলব্ধি করি এর নিশ্চিন্ত পরিবেশে লুকিয়ে আছে দিনযাপনের অনাবিল আনন্দ।
আমাদের পাড়া বরদা অ্যাভিনিউ। ১৯৬৪ সালে যখন এখানে এসেছিলাম তখন হাতে গোনা কয়েকটি নির্মীয়মাণ বাড়ি আর চার পাশে ছিল দিগন্ত বিস্তৃত ধানখেত। তবে আজকের পাড়াটাকে দেখে সে কথা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। অতীতের শহরতলি থেকে আজকের বৃহত্তর শহরের একটি পাড়া হয়ে ওঠার কাহিনিটি বর্ণময়। এ অঞ্চলে এখন আর ফাঁকা জায়গা নেই বললেই চলে। একে একে ফাঁকা জমিগুলিতে তৈরি হয়েছে বাড়ি। তবে পাড়াটায় প্রচুর গাছপালা থাকায় নানা প্রজাতির পাখির আনাগোনা আজও লেগে থাকে।
রাজা সুবোধ মল্লিক রোড থেকে শুরু হওয়া কেন্দুয়া রোড পেরিয়ে বরদা অ্যাভিনিউ আর তার শাখা-প্রশাখার অবস্থান। আশপাশের পাড়ার মধ্যে গড়িয়া পার্ক, মিলন পার্ক। শান্তিপূর্ণ এই পাড়ায় বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিস্টান সবাই মিলেমিশে থাকে।
বিশ্বনাথ বণিক
অন্য পাড়ার মতোই এখানেও মিলছে উন্নত নাগরিক পরিষেবা। নিয়মিত হয় রাস্তা পরিষ্কার, জঞ্জাল অপসারণ। নেই মশার উপদ্রব, জল জমার সমস্যা। নেই পার্কিং সমস্যাও। পাড়ার মাঠের চার পাশে বসেছে জোরালো আলো। রয়েছে ছোটদের একটি উদ্যানও। সেখানে আছে নানা খেলার সরঞ্জাম।
সময়ের প্রভাবে এখানেও কমেছে খেলাধুলোর পরিবেশ। আগে আশপাশের ক্লাবগুলির সঙ্গে আমাদের ক্লাবের ক্রিকেট ফুটবল ম্যাচ খেলা হত। এখনও মাঝে মাঝে ছেলেদের ব্যাডমিন্টন আর ক্যারাম খেলতে দেখা যায়।
আজও হারায়নি পাড়ার আড্ডার ছবিটা। আড্ডা বসে ক্লাবঘরে এবং মাঠে। আজও প্রবীণরা আড্ডা দিতে দিতে তাস খেলায় মাতেন। নবীনরা আড্ডা দেন মাঠে একটি ছাউনির নীচে বসে। তবে কর্মব্যস্ত যুব সম্প্রদায়কে আড্ডা দিতে দেখা যায় কেবল ছুটির দিনগুলিতে। এমনকী পাড়ার বাইরের বন্ধুরাও ছুটির দিনে আড্ডা দিতে চলে আসেন এ পাড়ায়। এমনই আড্ডার টান।
পরিবর্তনের ছোঁয়ায় হারায়নি সম্পর্কের উষ্ণতা আর আন্তরিকতা। আজও যে কোনও প্রয়োজনে পাড়া-পড়শিকে পাশে পাওয়া যায়। এখনও সকলে সকলকে নামেই চেনেন। একটা ঘটনার কথা বলি। এক বার বিবাদী বাগে আমি একটি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছিলাম। সেই সময় আমার ছেলে দেশের বাইরে ছিল। তখন পাড়ার মানুষ পালা করে হাসপাতালে রাত জেগেছিল এবং যে ভাবে সাহায্য করেছিল তা কখনও ভুলতে পারব না। এমনই এ পাড়ার মানুষের মূল্যবোধ।
আধুনিকতা যতই প্রভাব ফেলুক না কেন আজও আমাদের পাড়াটা পাড়াই আছে। পাড়ার কথা লিখতে বসে মনে আসছে শুরুর সেই দিনগুলোর স্মৃতি। এখানে মূলত পূর্ববঙ্গের মানুষের বসতি গড়ে ওঠে। মনে পড়ে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অন্যতম সদস্য অনন্ত সিংহও এখানে বাড়ি করে বসবাস করতেন।
প্রথম দিকে সেই সময় একটা ঘর ভাড়া করে শুরু হয়েছিল একটি রেশনের দোকান। তার পরে আশির দশকের গোড়ার দিকে তৈরি হল মিলনের দোকান। সে সময় পাড়ায় বিয়ে কিংবা যে কোনও অন্য অনুষ্ঠান উপলক্ষে মাঠে প্যান্ডেল তৈরি করে অনুষ্ঠিত হত। এতে পাড়া–পড়শিরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশ নিতেন। এমন কী পরিবেশনও করতেন।
এক সময় পাড়ার বন্ধুবান্ধবদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল পাড়ার দক্ষিণ ফাল্গুনী ক্লাব। নামকরণ করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এই ক্লাবেরই উদ্যোগে হত নাটক এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এখনও পুজোর সময় হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তাতে অংশগ্রহণ করেন পাড়ার মানুষ। পুজোর দিনগুলোয় পাড়াটা আজও জমজমাট হয়ে ওঠে। তেমনই পাড়ার কালীমন্দিরের কালীপুজোর আকর্ষণও কম নয়।
এক সময় এ পাড়ায় পথে পথে গান গেয়ে যেত বাউল। তখন শরৎ এলেই কাছাকাছির মাঠগুলি ভরে যেত কাশফুলে। অতীতে পাড়ায় ব্রতচারীর যেমন চল ছিল, তেমনই ছোটদের যোগব্যায়ামও শেখানো হত। আগে পাড়ার ক্লাবের উদ্যোগে চলত একটি লাইব্রেরি। সেটা আজ আর নেই। পাড়ারই এক চিকিৎসকের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তাঁদের উদ্যোগে বয়স্ক নাগরিকদের দেখাশোনা করা হয়।
জীবনযাত্রার সঙ্গে এমন ভাবে জড়িয়ে আছে পাড়াটা যে অন্যত্র যাওয়ার কথা ভাবতে পারি না। এমনই এ পাড়ার মায়াবী আকর্ষণ।
লেখক ব্যবসায়ী ও শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy