মেট্রোর রেকে হঠাৎ আগুন লাগলে তা নেভানো ও আতঙ্ক ছড়াতে না দেওয়ার কী ব্যবস্থা আছে, প্রশ্ন করা হয়েছিল এক আধিকারিককে। তাঁর নিরুত্তাপ উত্তর ছিল, ‘‘এক স্টেশন থেকে আর এক স্টেশনে যেতে মেট্রো সময় নেয় দু’-আড়াই মিনিট। ওটুকু সময়ে আর কতটা আগুন লাগতে পারে!’’
প্রতিক্রিয়া শুনে বিস্মিত না হয়ে উপায় ছিল না। বছর চারেক আগে দমদমগামী একটি ট্রেন রবীন্দ্র সদন স্টেশন ছাড়া মাত্র একটি কামরা থেকে অদ্ভুত শব্দ বেরোচ্ছিল। তাতেই যাত্রীদের মুখে মুখে রটে যায় ‘আগুন’। অফিসের ব্যস্ত সময়ে তখন চলন্ত ট্রেনের যাত্রীরা স্রোতের মতো ছুটছেন ট্রেনের পিছন দিকে। নন-এসি ওই রেকে বিপদঘণ্টি বাজাচ্ছিলেন যাত্রীরা। শেষে ময়দান স্টেশনে পৌঁছতে বোঝা গেল, পুরোটাই রটনা। ততক্ষণে অবশ্য বেশ কয়েক জন যাত্রী চোট পেয়েছেন, ভয়ে অসুস্থ হয়ে হাঁপাচ্ছেন আরও কয়েক জন।
মেট্রোর ওই কর্তাকে সেদিন বোঝানো যায়নি, আগুন লাগলে তো কথাই নেই, শুধু রটনাতেই পদপিষ্ট হয়ে যেতে পারেন বহু যাত্রী। অথচ এ ধরনের ঘটনায় যাত্রীদের আশ্বস্ত করার জন্য মেট্রোর কামরায় কোনও রকম ঘোষণা করার গরজ থাকে না। কর্তাদের একটা বড় অংশেরই ‘ও কোনও ব্যাপার না’ গোছের মনোভাব। যা দেখা গেল বুধবার বাঁশদ্রোণী স্টেশনের ঘটনাতেও। মেট্রো রেলের দাবি, ট্রেনের কামরায় নয়, আগুন লেগেছিল তৃতীয় লাইনে, যেখান দিয়ে বিদ্যুৎ পরিবহণ হয়। আর সেই লাইন থেকে নাকি মেট্রোর কামরায় আগুন ছোঁয়ার কথাই নয়।
অথচ বুধবার ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই কামরার তলায় আগুন দেখে ভয়ে বুক শুকিয়ে গিয়েছিল যাত্রীদের। তার পরে যখন ভয়ঙ্কর শব্দে বিস্ফোরণ হল, তখন আর বাধ মানেনি আতঙ্ক।
বাঁশদ্রোণীর রায়নগরের বাসিন্দা শতদ্রু জানা বললেন, ‘‘দ্রুত, নিরাপদ আর আরামদায়ক যাত্রার জন্যই তো মেট্রো। সেখানে কামরার তলায় আগুন জ্বলছে, বিস্ফোরণ হচ্ছে— এ সব দেখে এড়িয়ে যাওয়া সহজ নয়।’’
মেট্রোরেলের মুখ্য জনসংযোগকারী আধিকারিক ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, সূর্য সেন মেট্রো স্টেশনে যখন কবি সুভাষগামী ট্রেনটি ঢুকছিল, তখনই তৃতীয় লাইনে ধোঁয়া ও আগুন দেখেন মোটরম্যান। স্টেশনের কন্ট্রোল রুমের মনিটরে দেখে সতর্ক হয়ে যান কর্মীরা। তৃতীয় লাইনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্ন করে দেওয়া হয়। যাত্রীদের ট্রেন থেকে নামানোর পরে স্টেশন ফাঁকা করে দেওয়া হয়। শুরু হয় আগুন নেভানোর কাজ। ইঞ্জিনিয়ারেরা এসে লাইনে নেমে পরীক্ষা করেন। ঘোষণা করা হয়, বন্ধ থাকবে মহানায়ক উত্তমকুমার থেকে কবি সুভাষ পর্যন্ত মেট্রো পরিষেবা। ঘণ্টাখানেকের কিছু বেশি সময় মেট্রো বন্ধ থাকার পর দশটা পাঁচে ফের চালু হয়। তবে ইন্দ্রাণীদেবীর স্পষ্ট দাবি, আগুনের মাত্রা ভয় পাওয়ার মতো ছিল না এবং কোনও বিস্ফোরণও হয়নি।
তিনি বলেন, ‘‘মনে হচ্ছে বাইরে থেকে কোনও কিছু (ফরেন বডি) তৃতীয় লাইনে এসে পড়ায় স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়। তার জেরেই ধোঁয়া।’’ তিনি জানান, যে অংশে মাটির তলায় সুড়ঙ্গ দিয়ে মেট্রো চলে, সেখানে এমন হলে চিন্তার বিষয় ছিল। কিন্তু সূর্য সেন স্টেশন তো খোলা আকাশের নীচে। বাইরে থেকে কিছু চলে আসাই বিচিত্র নয়। আর ওই তৃতীয় লাইন দিয়ে এতই উচ্চভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, সামান্য কিছুর সংস্পর্শেই স্ফুলিঙ্গ তৈরি হতে বাধ্য। তবে ঠিক কী ঢুকেছিল, তা জানা সম্ভব নয়। ইঞ্জিনিয়ারদের ব্যাখ্যা, অত উচ্চভোল্টে যে তাপমাত্রা থাকে, তাতে যে কোনও কিছু কয়েক সেকেন্ডে গলে যায়। ফলে আগুন নিভলেও লাইনে কিছুই মেলেনি।
যাত্রীদের কাছে মেট্রো যেন এখন নিত্য ভোগান্তির আর এক নাম। পরিবেশ বান্ধব এই পরিবহণ ব্যবস্থা আদৌ কতটা যাত্রী-বান্ধব, এখন প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েই।
যেমন, ২৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে একটি এসি রেক যতীন দাস পার্ক স্টেশনে ঢোকার মুখে বিকল হয়ে যায়। ট্রেন থেমে, অথচ দরজা খোলার নাম নেই। নেই কোনও ঘোষণাও। অস্বস্তি ও আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনেকে, কাঁদতে শুরু করেছে শিশুরা। কেউ দরজা ও জানালায় ধাক্কা দিচ্ছেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। অনেকেই কামরায় অ্যালার্ম বেলের সুইচ টিপলেন। তাতে সরু, কালো স্ক্রিনে লাল ইংরেজি হরফে ফুটে উঠল, ‘ড্রাইভার অ্যাওয়্যার।’ কিন্তু দরজা খোলার নাম নেই। একটি কামরার এক যাত্রী জানালেন, তিনি মেট্রোর স্টাফ, দরজার উপরে একটি চৌকো আবরণ খুলে একটি সুইচ ঘোরালেই দরজা খুলে যাবে। কিন্তু তাঁর কাছে স্ক্রু ড্রাইভার নেই। এক যাত্রীর মন্তব্য, ‘‘তা হলে এ বার মেট্রোয় কলকব্জা নিয়ে উঠতে হবে।’’ মিনিট কুড়ি পর দরজা খুলেছিল।
এক দিকে যান্ত্রিক গোলযোগ, অন্য দিকে, মেট্রোর নিরাপত্তার জন্য নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্র। টালিগঞ্জ-সহ গুরুত্বপূর্ণ বহু স্টেশনে দেড় বছরের উপর অনুপস্থিত এক্স রে ব্যাগেজ স্ক্যানার। ডোর ফ্রেম মেটাল ডিটেক্টর আদৌ কাজ করে, নাকি স্রেফ লোকদেখানো, তা নিয়ে রহস্য। হ্যান্ড হেল্ড মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে কলকাতা পুলিশ ও আরপিএফের কয়েক জন স্টেশনে স্টেশনে মোতায়েন আছেন যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশির জন্য। তবে অনেক সময়েই তাঁদের একটা বড় অংশ সেই তল্লাশি চালান না কিংবা খোশগল্প করতে করতে বা অন্য দিকে তাকিয়ে সেই কাজ করেন।
অথচ দেশ জুড়ে জঙ্গি হামলার আতঙ্কের আবহে এই মেট্রোই নাকি অন্যতম ‘সফ্ট টার্গেট’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy