প্রতীকী ছবি।
খানিকটা অন্তরালে থেকে এ বার পুর স্বাস্থ্যকর্তাদের কপালের ভাঁজ বাড়িয়ে দিয়েছে যক্ষ্মা। দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় যক্ষ্মা নিবারণ কর্মসূচির পরেও খাস কলকাতায় যক্ষ্মা সংক্রমণের যে ছবি কেন্দ্রের সমীক্ষায় প্রকাশ্যে এসেছে, তাতে দুশ্চিন্তায় কলকাতা পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগ।
কেন্দ্রীয় সরকার থেকে প্রকাশিত সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, কার্যত কোনও ওষুধেই সারবে না, এমন মারাত্মক ধরনের যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কলকাতায় প্রচুর। বেড়েছে শিশু যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যাও।
পুর কর্তাদের অনেকেই মানছেন, ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার মতো রোগ বছরের নির্দিষ্ট একটা সময়ে হঠাৎ বেড়ে যায়। তাতে পরপর অনেকে মারাও যান। তাই এই রোগ নিয়ে হইচই বেশি হয়। পুরসভাও সারা বছর মশাবাহিত ওই সব রোগের মোকাবিলাতেই ব্যস্ত থাকে। তাতে অবহেলিত হয় অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রোগের বিরুদ্ধে লড়াই।
সেই সমস্ত রোগের ক্ষতি করার বা মারণ-ক্ষমতা কিন্তু কম নয়। বিশেষ কোনও মরসুমে সেগুলির প্রকোপ ছড়ায় না বলে প্রচার ততটা হয় না। পুর কর্তারাও সেই রোগ মোকাবিলায় কম তৎপরতা দেখান, তাতে রোগ আরও ছড়ানোর সুযোগ পায়। যক্ষ্মা হল তেমনই একটি রোগ।
কেন্দ্রের ২০১৭ সালের রিপোর্ট জানাচ্ছে, কলকাতায় ২০১৪ থেকে ২০১৭-র জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ও পুরসভার স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে সাধারণ যক্ষ্মা রোগী বাদ দিয়ে শুধু ‘মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট’ (এমডিআর, যাঁদের দেহে যক্ষ্মার প্রচলিত ওষুধ কাজ করবে না) যক্ষ্মা রোগীই মিলেছে ১০৫৪ জন। এঁদের মধ্যে ৬৮ জনই হলেন ‘এক্সট্রিমলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট’ (এক্সডিআর) যক্ষ্মা রোগী, যাঁদের দেহে কার্যত যক্ষ্মার কোনও ওষুধই কাজ করবে না। এঁদের তিন জনই চিকিৎসক। যাঁরা চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজেরাই সংক্রমিত হয়েছেন। পাঁচটি শিশুও রয়েছে। এই রোগে মৃত্যু-হার অত্যন্ত বেশি।
এক্সডিআর যক্ষ্মা যে এই হারে ছড়াচ্ছে, সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না পুরসভার স্বাস্থ্যকর্তাদের। উদ্বেগের বিষয় হল, এই সব রোগীর হাঁচি-কাশি থেকেও অন্য কারও দেহে রোগ ছড়ালে তাঁর সরাসরি এক্সডিআর যক্ষ্মাই হবে। পুরসভার টিবি অফিসার বিজয় করের কথায়, ‘‘এটা তো শুধু সরকারি পরিসংখ্যান। এর বাইরে বেসরকারি চিকিৎসক ও হাসপাতালে অনেক এক্সডিআর যক্ষ্মা রোগী থাকতে পারেন।
অর্ধেক রোগীর খবর আমাদের কাছে আসেই না। অনেক রোগী মাঝপথে চিকিৎসা ছেড়ে দেন। এবং সব চেয়ে বিপজ্জনক হল, এঁরা এই শহরে হয়তো আমাদের আশপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং রোগ ছড়াচ্ছেন।’’
কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, কলকাতার মানিকতলা এলাকার মোট যক্ষ্মা রোগীর আট শতাংশই হল শিশু। একই ভাবে বাগবাজারে চার, আলিপুরে পাঁচ, ট্যাংরা ও মনসাতলায় নয়, হাজি ও স্ট্র্যান্ড ব্যাঙ্ক এলাকায় সাত ও বেহালায় তিন শতাংশ যক্ষ্মা রোগী শিশু। পুর কর্তারাই জানাচ্ছেন, এদের অধিকাংশ বস্তি বা ফুটপাথের বাসিন্দা। জন্ম থেকেই অপুষ্টি বেশি এবং ছোট জায়গায় ঘেঁষাঘেঁষি করে এদের বাস। তাতে রোগ সহজে বাসা বাঁধে।
কলকাতায় এক্সডিআর যক্ষ্মা এত বাড়ছে কেন? বিজয়বাবুর কথায়, ‘‘এমনিতেই এমডিআর টিবি রোগী শহরে থিকথিক করছে। তাঁদেরই অনেকের এক্সডিআর হচ্ছে। আমাদের লোক কোথায় যে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগী খুঁজব বা সচেতনতা অভিযান চালাব? কলকাতার ১০টি যক্ষ্মা জেলার এক-একটিতে পাঁচ লক্ষ মানুষ-পিছু মাত্র সাত-আট জন করে লোক। এই ভাবে কি রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায়?’’
পুর স্বাস্থ্যকর্তারা আরও জানিয়েছেন, ফুসফুস বাদে শরীরের অন্য বিভিন্ন অঙ্গেও যে যক্ষ্মা হতে পারে বা উচ্চবিত্ত পরিবারেও যে এই রোগ ছড়াতে পারে, সেই ধারণা এখনও অনেক মানুষের নেই। ফলে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা ধাক্কা খাচ্ছে। অনেক চিকিৎসক ঠিক ভাবে যক্ষ্মা নির্ণয় করতে পারছেন না। নতুন রোগী পেলে বা রোগী মাঝপথে চিকিৎসা ছেড়ে গেলে সে কথা সরকারি স্তরে জানাচ্ছেন না। তাঁদের আরও অভিযোগ, পুরসভার হাতে এখন ৩৮টি সিভি-ন্যাক মেশিন আছে, যার মাধ্যমে নিখরচায় ও নির্ভুল ভাবে যক্ষ্মা নির্ণয় করা যায়। কিন্তু অনেক চিকিৎসকই রোগীদের সেখানে পাঠান না। ফলে অনেকে উন্নতমানের পরীক্ষা করাতে পারছেন না। এই সব কিছুই এক্সডিআর বা এমডিআর যক্ষ্মার বৃদ্ধির জন্য দায়ী বলে মনে করছেন পুর স্বাস্থ্যকর্তারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy