বাজেটে শুধুমাত্র কলকাতার জন্যই ১২টি উড়ালপুল, দু’টি স্কাইওয়াক, চারটি রাস্তা তৈরি বা সংস্কারের কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যা সামনে রেখে ভোটের আগে পথের বিপদ নিরসন করে দেওয়ার প্রচারও শুরু হয়ে গিয়েছে। যদিও নানা মহলেই প্রশ্ন, ভারী লরির দাপট কমাতে না পারলে কি আদৌ উড়ালপুল বা রাস্তা করে পথের বিপদ কমানো সম্ভব? এমনও প্রশ্ন উঠছে যে, নির্মাণের সময়ে উড়ালপুলের গুণগত মানের দিকে নজর দেওয়া হবে তো?
সেতু বিশেষজ্ঞদের বড় অংশ যদিও সতর্ক করে বলছেন, “গুণগত মানের দিকে নজর না দিলে আর ভারী লরির চাপ কমাতে না পারলে শহরের উড়ালপুলের স্বপ্ন ধাক্কা খেতে পারে।” তাঁদের ব্যাখ্যা, ৫.৩ মিটারের বেশি চওড়া দুই লেনের উড়ালপুল বা সেতুর ভার বহন ক্ষমতা ১০০ টন (‘ইন্ডিয়ান রোড কংগ্রেস’-এর বিধি অনুযায়ী)। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাবিত উড়ালপুলে প্রথমে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না হলে যে কোনও সেতু বা উড়ালপুলের বহন-ক্ষমতা কমে যেতে পারে। সেই অবস্থায় ভারী যানবাহন যত বেশি চলাচল করবে, সমস্যা ততই বাড়বে। সেতু বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ সোম বললেন, ‘‘নতুন উড়ালপুল ৩০ টন ওজনের বাস তো বটেই, ভারী পণ্যবাহী যানবাহনের ভার বহনেও উপযোগী। তবে উড়ালপুলের নকশা ঠিকমতো তৈরি করা দরকার। সময়মতো রক্ষণাবেক্ষণটাও প্রয়োজন। সেখানে ফাঁক থাকলেই সমস্যা হয়।”
মাঝেরহাট সেতু ভেঙে পড়ার পরেই তড়িঘড়ি শহরের সেতু ও উড়ালপুলগুলির স্বাস্থ্য পরীক্ষায় জোর দেওয়া হয়। তাতে দেখা যায়, বহু সেতু বা উড়ালপুলই মাত্রাতিরিক্ত ভার বহন করছে। দীর্ঘদিন ধরে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেশ কয়েকটি সেতু ও উড়ালপুল আবার ভার বহনের ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছে। সেই তালিকায় থাকা টালা সেতুর সংস্কার দ্রুত শুরু করতে হয় সরকারকে। নির্মাণ বা সংস্কারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা আদৌ উড়ালপুলের গুণগত মানের দিকে নজর দিয়েছিল কি না, প্রশ্ন ওঠে তা নিয়েও। মাত্রাতিরিক্ত ভার নিয়ে চলা লরিও সেতু ভাঙার একটি বড় কারণ বলে পরীক্ষায় উঠে আসে। এর পরে শহরের একাধিক সেতুতে লরি ওঠা বন্ধ হলেও লরির মাত্রাতিরিক্ত ভার নিয়ে শহরের রাস্তায় দাপিয়ে বেড়ানো বন্ধ হয়নি। বন্ধ হয়নি বেলগাছিয়ার মতো উড়ালপুলে ভারী লরির চলাচলও।
লরি সংগঠনের সদস্যেরা যদিও জানাচ্ছেন, কেন্দ্র ২০১৮-র জুলাইয়েই আগের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি ভার বহনের ছাড়পত্র দিয়েছে লরিগুলিকে। কিন্তু সেই নিয়ম এ রাজ্যে চালু হয়নি। রাস্তা, সেতু বা উড়ালপুলের ভার বহনের ক্ষমতা খতিয়ে দেখে তবেই কেন্দ্রের নিয়ম চালু হবে বলে জানানো হয়েছিল। কিন্তু অভিযোগ, কেন্দ্রের ২৫ শতাংশ ভার বাড়ানোর নিয়মে ছাড়পত্র না দিয়ে রাজ্য একেবারে ১০-১৫ গুণ ভার বাড়ানোর অলিখিত ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে। তোলা দিতে পারলেই মেলে সেই অলিখিত ছাড়পত্র। বিনা বাধায় পার হওয়া যায় ট্র্যাফিক সিগন্যাল!
পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, রাজ্যে ছ’চাকা থেকে ১২ চাকা পর্যন্ত লরির বহন-ক্ষমতা নির্দিষ্ট করা রয়েছে। যেমন, ছ’চাকার লরির আট থেকে দশ টনের বেশি ওজন তোলার কথা নয়। আট চাকার লরির ক্ষেত্রে সেটি ১৬ টন। ১০ এবং ১২ চাকার লরির ক্ষেত্রে এই হিসেব যথাক্রমে ২৫ ও ২৭ টন। কিন্তু প্রায় সব লরিই নির্দিষ্ট ধারণক্ষমতার চেয়ে বহু গুণ বেশি ওজন নিয়ে শহরে ঢুকছে বলে অভিযোগ। লরিচালকদের একটি সংগঠনের নেতা নিমাই কর্মকার বলেন, “মাপতে গেলে দেখা যাবে, যেটির আট থেকে দশ টন নেওয়ার কথা, সেটি ২৫-৩০ টন নিয়ে শহরে ঢুকেছে। যার ২৫ টন নেওয়ার কথা, সে এনেছে ৬০ টন। ২৭ টনের লরিতে চাপানো হয়েছে ৯০ টন বা তারও বেশি!” নিমাইবাবুর প্রশ্ন, “এমন লরি কী করে বিনা বাধায় চলে যায়, উড়ালপুল গড়ার আগে তা ভাবা উচিত সরকারের।”
‘ফেডারেশন অব ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রাক অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি সজল ঘোষ বললেন, “রাজ্য জুড়ে টাকা তোলা চলছে। টাকা দিয়ে কাগজ বানাতে হয়। সেই কাগজেই লোকের নম্বর দেওয়া থাকে। সেই লোককে ফোন করলেই শহরে লরি পাস হয়ে যায়।” তাঁরা কারা? সজলবাবুর দাবি, “স্পষ্ট করে বলা যাবে না। কিন্তু তাঁদের পুলিশও ধরে না, পরিবহণ দফতরও ছোঁয় না।”
রাজ্য পরিবহণ দফতরের কেউ এ নিয়ে মন্তব্য করেননি। দক্ষিণ কলকাতার এক রিজিয়োনাল ট্রান্সপোর্ট অফিসার শুধু বললেন, “ভোটের আগে কিছু নিয়েই মুখ খোলা যাবে না। ভোটের উপহার উড়ালপুলের ঘোষণা পরে বাস্তবায়িত হয় কি না, দেখা যাক!” ভারী লরি প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “লরির আয় পৌঁছয় বহু দূর। তাই উড়ালপুলের চাহিদায় সেই মায়া ছাড়া যাবে বলে মনে হয় না।” পুলিশের ট্র্যাফিককর্তারা ছুটিতে আছেন বলে মন্তব্য এড়িয়ে গিয়েছেন।