Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

পান্ডা অধরাই, পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণে দোষী ৩

মূল অভিযুক্ত এখনও ফেরার। সেই অবস্থাতেই চার বছর আগের পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণ-মামলার রায় ঘোষণা হয়ে গেল। দোষী সাব্যস্ত হল ধৃত তিন অভিযুক্ত। একই সঙ্গে নস্যাৎ হল ‘সাজানো ঘটনা’র তত্ত্বও। পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ড সামনে আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী সেটিকে ‘সাজানো’ তকমা দেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:৩১
Share: Save:

মূল অভিযুক্ত এখনও ফেরার। সেই অবস্থাতেই চার বছর আগের পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণ-মামলার রায় ঘোষণা হয়ে গেল। দোষী সাব্যস্ত হল ধৃত তিন অভিযুক্ত। একই সঙ্গে নস্যাৎ হল ‘সাজানো ঘটনা’র তত্ত্বও। পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ড সামনে আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী সেটিকে ‘সাজানো’ তকমা দেন। বৃহস্পতিবার আদালত জানিয়েছে, ওই রাতে গাড়িতে গণধর্ষণই হয়েছিল।

পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত কাদের খান ও আর এক অভিযুক্ত মহম্মদ আলি খান পুলিশের নাগালের বাইরে। তাই তাদের বিচার হয়নি। কলকাতা নগর দায়রা আদালতে এ দিন দোষী সাব্যস্ত হয়েছে— নাসের খান, রুমান খান ও সুমিত বজাজ। আজ, শুক্রবার সাজা ঘোষণা হবে।

চার বছর আগে ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ করে প্রথমে থানার পুলিশ, পরে শাসকদলের একাধিক নেতা-নেত্রীর বিদ্রুপ ও অসম্মানজনক মন্তব্যের মুখে পড়েছিলেন যিনি, সেই সুজেট জর্ডন অবশ্য এই রায় শুনে যেতে পারেননি। ন’মাস আগে এনসেফ্যালাইটিসে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। রায় শুনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ‘সাজানো ঘটনা’র প্রসঙ্গ তোলেননি। বরং আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। ঘনিষ্ঠমহলে মুখ্যমন্ত্রী এ-ও বলেছেন, দোষীদের কড়া শাস্তি হওয়া উচিত, ওরা জীবনভর জেলে থাকুক। এ দিন কোর্ট চত্বরে দাঁড়িয়ে নির্যাতিতার বাবা পিটার জর্ডনের প্রতিক্রিয়া, ‘‘প্রমাণিত হল, ঘটনাটা সাজানো ছিল না।’’

সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন...

পুলিশ সূত্রের খবর, ২০১২-র ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে পার্ক স্ট্রিটের এক হোটেলের সামনে সুজেটকে গাড়িতে তুলেছিল পাঁচ যুবক। মহিলাকে চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণ করে এক্সাইড মোড়ের কাছে ফেলে তারা চম্পট দেয়। ৮ ফেব্রুয়ারি পার্ক স্ট্রিট থানায় অভিযোগ জানালেও পুলিশ গুরুত্ব দেয়নি বলে দাবি করেছিলেন সুজেট। ব্যাপারটা সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হতে শোরগোল পড়ে। লালবাজার নড়ে-চড়ে বসে। তদন্তভার গোয়েন্দা বিভাগের উপরে ন্যস্ত হয়। গোড়ায় অভিযোগকারিণীর বয়ান শুনে গোয়েন্দারা দুই যুবককে আটক করেন। দেখা যায়, তাদের সঙ্গে ঘটনার কোনও যোগ নেই।

ফের অভিযোগকারিণীকে ডেকে পাঠানো হয়। তাঁর বয়ান ও সংশ্লিষ্ট হোটেলের সিসিটিভি’র ফুটেজ মিলিয়ে চিহ্নিত করা হয় পাঁচ যুবককে— কাদের খান, নাসের খান, রুমান খান সুমিত বজাজ ও মহম্মদ আলি খান। নাসের আবার সম্পর্কে কাদেরের ভাই। তদন্তকারীদের দাবি, সেই রাতে সুমিত গাড়ি চালাচ্ছিল।

পড়ুন: কুৎসা সত্ত্বেও জানতাম, সত্যিটা বেরোবে

এমন সময় সুজেটই নেই! খুব আফসোস হচ্ছে

এমন সময় সুজেটই নেই! খুব আফসোস হচ্ছে

দময়ন্তীর দেখানো পথেই পুলিশের ‘শাপমোচন’

নাসের, রুমান, সুমিতকে গ্রেফতারে দেরি হয়নি। অথচ মূল অভিযুক্ত যে, সেই কাদেরের টিকি ছোঁয়া যায়নি। যা নিয়ে গুঞ্জন দানা বেঁধেছে লালবাজারের অন্দরেই। প্রশ্ন উঠেছে, রানাঘাটে সন্ন্যাসিনী ধর্ষণ-কাণ্ডে রাজ্যের গোয়েন্দারা তিন বাংলাদেশি-সহ সব অভিযুক্তকে তিন মাসের মধ্যে পাকড়াও করেছে। সেই পুলিশই চার বছরে কাদেরের হদিস পেল না কেন?

বস্তুত লালবাজারের একাংশের সন্দেহ, শাসকদল ও পুলিশের কিছু মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদেই কাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। একটি সূত্রের দাবি, কাদেরের বান্ধবী টালিগঞ্জের এক অভিনেত্রী, যাঁর সঙ্গে রাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর সম্পর্ক খুব ভাল। সেই সূত্রে মন্ত্রীর ছত্রচ্ছায়া কাদেরের মাথাতেও বিস্তৃত। ‘‘এক বার খবর আসে, কাদের রয়েছে মুম্বইয়ের হোটেলে। লালবাজারের টিম পৌঁছনোর দশ মিনিট আগে সে পালায়!’’— আক্ষেপ করছেন এক অফিসার। কিছু গোয়েন্দার ধারণা, পুলিশের ভিতর থেকেই কাদেরকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল।

এ দিকে গণধর্ষণের অভিযোগ পেশের পর থেকেই প্রশাসন তথা শাসকদলের কোপের মুখে পড়েন সুজেট। মুখ্যমন্ত্রী এটিকে শুধু ‘সাজানো ঘটনা’ বলেই ক্ষান্ত হননি। তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল, রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতেই ঘটনাটি সাজানো হয়েছে। কলকাতার তদানীন্তন পুলিশ কমিশনার রঞ্জিৎকুমার পচনন্দাও মুখ্যমন্ত্রীর সুরে সুর মিলিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বলে দেন, ‘‘সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে অপপ্রচার করা হচ্ছে।’’ এমনকী তৃণমূলের সাংসদ অর্পিতা ঘোষ, কাকলি ঘোষদস্তিদার-সহ একাধিক নেতা-নেত্রী সুজেটের ‘চরিত্র’ নিয়েও প্রকাশ্যে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। সে সময় মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা তৎকালীন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রও নির্যাতিতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

রায় ঘোষণার পরে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র মন্তব্য করেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কি এ বার তাঁর ওই মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইবেন?’’ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়াও বলেন, ‘‘আশা করি, আদালতের রায় থেকে

শিক্ষা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এ বার ‘সাজানো’ তত্ত্ব দেওয়া বন্ধ রাখবেন!’’

আলোয় স্মরণ: রায় ঘোষণার পরে সুজেটের সমাধিতে বাতি। বৃহস্পতিবার ভবানীপুরের গোরস্থানে সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।

‘প্রতিকূল’ পরিবেশের মধ্যেও লালবাজারের একাংশ সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা ছাড়েনি। ‘সাজানো ঘটনা’র তত্ত্ব খারিজ করে তদানীন্তন গোয়েন্দা-প্রধান দময়ন্তী সেন প্রথম জানিয়ে দেন, সুজেট জর্ডন গণধর্ষণেরই শিকার। মূলত তাঁরই উদ্যোগে তিন অভিযুক্তকে ধরা হয়। তার পরেই দময়ন্তীর ডাক পড়ে মহাকরণে। ২০১২-র সেই ২০ ফেব্রুয়ারি দুপুরে দেখা গিয়েছিল, মু্খ্যমন্ত্রীর ঘর থেকে থমথমে মুখে বেরিয়ে আসছেন গোয়েন্দা-প্রধান।

সেই ইস্তক দময়ন্তী আর মুখ খোলেননি। ক’দিন বাদে তিনি ব্যারাকপুরের পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বদলিও হয়ে যান। এ দিন সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রশ্ন, ‘‘তদন্তে সাহসী ভূমিকা নেওয়ায় যে মহিলা আইপিএস অফিসারকে বদলি হতে হয়েছিল, তাঁর কাছে কি মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী ক্ষমা চাইবেন?’’

যে মামলার প্রেক্ষাপটে এমন বিতর্কের ঘনঘটা, তার রায় শোনার জন্য সব মহলে আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। এ দিন সকাল থেকে ব্যাঙ্কশাল কোর্ট চত্বরের বিচারভবনে নগর দায়রা আদালতের সামনে ভিড় জমতে শুরু করে। সকাল দশটা নাগাদ তিন অভিযুক্তকে নিয়ে আসা হয়। ঘণ্টা দুয়েক লক-আপে রেখে তাদের তোলা হয় ফাস্ট ট্র্যাক সেকেন্ড কোর্টের বিচারক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের এজলাসে। অভিযুক্তপক্ষের কৌঁসুলি অশোক বক্সী, তপেশ ভট্টাচার্য ছাড়াও এজলাসে তখন সাংবাদিক, আইনজীবী ও অভিযুক্তদের আত্মীয়-পরিজনের ঠাসাঠাসি ভিড়। পরিস্থিতি দেখে আইনজীবী ছাড়া সকলকে এজলাস ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলেন বিচারক। রুদ্ধদ্বার কক্ষে তিনি রায় ঘোষণা করেন।

কোর্ট-সূত্রের খবর: বিচারক রায়ে বলেছেন, নাসের-রুমান-সুমিতের বিরুদ্ধে গণধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত। সরকারি কৌঁসুলি অমলেন্দু চক্রবর্তী জানান, তিন জনই ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৬(২)(জি) ধারায়, অর্থাৎ গণধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। রুমান ও নাসের আইপিসি’র ৫০৬, ৩২৩, ১২০বি, ও ৩৪ নম্বর ধারাতেও দোষী প্রমাণিত। আইনি মহলের খবর: এ সব ক্ষেত্রে দশ বছর থেকে শুরু করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

কাদের খান ও মহম্মদ আলির কী হবে? আইনজীবীদের বক্তব্য: ধরা পড়লে দু’জনের বিরুদ্ধে পুলিশকে অতিরিক্ত চার্জশিট পেশ করতে হবে। সেই অনুযায়ী দু’জনের জন্য নতুন করে শুনানি শুরু করতে হবে।

মূল অভিযুক্ত বিচারের আওতার বাইরে রয়ে গেলেও আদালতের এ দিনের রায় নির্যাতিতার পরিবারের কাছে যেন এক ঝলক তাজা বাতাস বয়ে এনেছে। ‘‘আমরা খুব খুশি।’’— রায় শুনে বলেন সুজেটের বোন নিকোলা। এ দিন আদালত থেকে তাঁরা সোজা চলে গিয়েছিলেন ভবানীপুরের গোরস্তানে। সেখানে সুজেটের কবরে মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করেন পরিজনেরা।

অন্য দিকে এজলাসে শোনা গিয়েছে বিলাপের সুর। বিচারক রায় ঘোষণা করে আসন ছেড়ে উঠে যেতেই নাসের ও সুমিত কান্নায় ভেঙে পড়ে। শোনা যায়, সুমিত কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির লোককে বলছে, ‘‘আর কী হবে? আমরা তো দোষী হয়েই গেলাম!’’ ছেলেকে ভরসা দিয়ে বাবা বলেন, ‘‘তাতে কী হয়েছে? এ বার আমরা হাইকোর্টে যাব।’’ একই যুক্তি শুনিয়ে রুমান আবার উল্টে নিজের পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়েছে।

‘‘অব আপলোগোঁকো হাইকোর্ট যানা চাহিয়ে।’’— শান্ত মুখে পরিজনদের পরামর্শ দিয়েছে রুমান খান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE