E-Paper

‘একটি মুজিবরের’ মূর্তিতে ইতিহাসের ক্ষতচিহ্ন

ইতিহাসের বিচারে বঙ্গবন্ধুও দোষে, গুণে মানুষ! কিন্তু তাঁর মূর্তির উপরে উঠে সেই মূর্তিতেই হাতুড়ি মারার ছবি, কারও কাছে ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাস!

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২৪ ০৭:২৮
অতীত-বর্তমান: ১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতার রাজভবনে পুরসভার আয়োজনে মুজিবুর রহমানকে সংবর্ধনা।

অতীত-বর্তমান: ১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতার রাজভবনে পুরসভার আয়োজনে মুজিবুর রহমানকে সংবর্ধনা। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

তখন টিভি ছিল না। ঢাকার ছবি ঘরে বসে দেখতে পায়নি কলকাতা। তবে সেই ডিসেম্বর বিকেলে ধর্মতলা চত্বরের ছবিটা আজও সত্তরোর্ধ্ব বা অশীতিপর কারও চোখে আঁকা। এ শহরের আকাশ-বাতাস মথিত করে মোড়ে মোড়ে বাংলাদেশের বিজয় দিবসে একটাই সুর বাজছিল, ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি...’

পাঁচ দশক বাদে সেই বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ঢাকায় চুরমার করার দৃশ্যে খানিক বিমূঢ় কলকাতা। আকাশবাণীর অবসরপ্রাপ্ত সংবাদ অধিকর্তা, ৮৫ বছর বয়সি শঙ্কর দাশগুপ্ত বলছেন, ‘‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিনটাও আমার মনে আছে। কিন্তু বাংলাদেশে তাঁর সুবিশাল মূর্তির গায়ে হাতুড়ির ঘা যেন আমারও বুকে বাজছিল। টিভি-র সামনে বসে চোখে জল আসছিল!’’ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আকাশবাণী ভবনের পাঁচতলার একটি ঘরে বসে সারা পৃথিবীর সব বেতারকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ বিষয়ক খবরাখবর সংবাদ বিভাগের জন্য তর্জমা করতেন তিনি। বার চারেক সীমান্তের ও-পারে খবর করতেও গিয়েছেন। প্রবীণ সাংবাদিক বলছিলেন, ‘‘বাংলাদেশের বিজয় দিবসে যদ্দূর মনে পড়ে, আমি কুমিল্লায় ছিলাম। তখন চারপাশে ধ্বংসের চিহ্ন দেখেছি। এর পরে ১৯৯১-’৯৫ ঢাকায় আকাশবাণীর প্রতিনিধি আমি। ভারত-বিরোধী মেজাজ টের পেয়েছি। তখন বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনা নিজে আমায় ধানমন্ডির বাড়িতে মুজিব-হত্যার সময়ে কোথায় কী ঘটেছিল, শোনান! কিন্তু ঢাকায় প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি চুরমার করা হবে, দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি!’’

ইতিহাসের বিচারে বঙ্গবন্ধুও দোষে, গুণে মানুষ! কিন্তু তাঁর মূর্তির উপরে উঠে সেই মূর্তিতেই হাতুড়ি মারার ছবি, কারও কাছে ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাস! সমাজমাধ্যমে কেউ কেউ এমন ছবি, গাছের ডালে বসে সেই ডালই কাটতে থাকা ‘কালিদাসের কাণ্ড’ আখ্যা দিয়েছেন। কারও আক্ষেপ, কন্যা শেখ হাসিনার জন্যই বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি কলঙ্কিত হল। এ মূর্তি ভাঙার সঙ্গে আফগানিস্তানের বামিয়ানের বুদ্ধ মূর্তি ভাঙার দৃশ্যটিও কারও স্মৃতিতে দগদগে হয়ে উঠেছে।

৫ অগস্ট ২০২৪-এ ঢাকায় ভাঙা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর মুরাল।

৫ অগস্ট ২০২৪-এ ঢাকায় ভাঙা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর মুরাল। ছবি: সংগৃহীত।

এ শহরের প্রাক্তন স্কুলশিক্ষিকা, ৮৮ বছরের মরিয়ম ওয়ালি এখনও নিয়মিত ফোনে খবর দেখেন। বললেন, ‘‘প্যালেস্তাইনের ঘটনা থেকে দেশের নানা খবরের খুঁটিনাটি মনে রাখি। বাংলাদেশের কোটা-বিরোধী আন্দোলন থেকে এত কিছু ঘটবে, বুঝতেই পারিনি। বঙ্গবন্ধু তো সব বাঙালির কাছেই নায়ক ছিলেন। তাঁর মূর্তি ভাঙায় মনে কষ্টই হচ্ছে।’’

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে মরিয়মের পূর্ব পাকিস্তানের আত্মীয়েরা অনেকেই বেকবাগানে তাঁর মা-বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর বাঘা যতীনের ১১ বছরের বালক পরীক্ষিৎ ধর তখন আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে মুক্তিযুদ্ধের যে কোনও ছবি বা খবর কেটে একটি খাতায় সেঁটে জমাতেন। তাঁদের পড়শি, ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে সেই খাতা দেখে মুগ্ধ হয়ে পরে এশিয়াটিক সোসাইটির জন্য চেয়ে নেন। এখন ব্যবসা সূত্রে জ়াম্বিয়ার লুসাকায় থাকেন ষাটোর্ধ্ব পরীক্ষিৎ। এখনও স্মৃতি থেকে অনর্গল বলেন মুজিবের বিখ্যাত বক্তৃতা। ফোনে বলছিলেন, শেখ মুজিব আমাদের কাছে হলিউডের হিরোর মতো ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর ঘটনা গোটা উপমহাদেশের জন্য শোকের। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, সেটা তো কিছু লোকের বিশ্বাসঘাতকতা ছিল। এ বার যেটা ঘটল, তা মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি ছাড়া আর কী বলতে পারি!’’

শেখ হাসিনার পতনে অনেকে দারুণ খুশি! তবে অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কার সুরটিও প্রবল। বঙ্গবন্ধুর আধভাঙা মূর্তিতে অনেকেই ইতিহাসের ক্ষতচিহ্ন দেখছেন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

bangladesh unrest Bangladesh Bangladesh violence Bangladesh Protest

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy