কলেজের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এবং ধৃতদের মধ্যে এক জনের মোবাইল থেকে পাওয়া ভিডিয়োর সঙ্গে অভিযোগকারিণীর বয়ান মিলিয়ে দেখে তদন্তে অনেকটাই এগিয়েছে পুলিশ। এ বার তরুণী এবং ধৃতদের ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে দেখে এই গণধর্ষণ মামলার তদন্তে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাইছেন তদন্তকারীরা। সেই সূত্রেই শনিবার রাতে নির্যাতিতা তরুণীকে ঘটনাস্থলে নিয়ে গিয়ে ঘটনার পুনর্নিমাণ করেছে পুলিশ। এর পরে গভীর রাতেই পুলিশ ধৃত তিন জনের বাড়ি গিয়ে তাদের ঘটনার দিনের পোশাক বাজেয়াপ্ত করে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণের নমুনাও সংগ্রহ করা হয় বলে সূত্রের খবর। লালবাজারের দাবি, তদন্তে ফাঁক না রাখতে বিশেষ তদন্তকারী দলের (সিট) সদস্য সংখ্যা পাঁচ থেকে বাড়িয়ে ন’জন করা হয়েছে।
আর জি কর কাণ্ডের পরে শিক্ষাঙ্গনে পড়ুয়ার গণধর্ষণের ঘটনায় ফের শোরগোল পড়েছে। এ দিনও শহরের নানা জায়গায় দফায় দফায় বিক্ষোভ হয়। মহিলাদের নিরাপত্তার বিষয়ে সুর চড়িয়ে প্রশাসনিক ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছেন অনেকে। যদিও নির্যাতিতা তরুণীর পরিবার প্রশাসনের উপরেই আস্থা রাখছে। তরুণীর মামা রবিবার জানান, পুলিশ যে ভাবে তদন্ত চালাচ্ছে, তাতে তাঁরা খুশি। কলকাতা পুলিশের উপরে আস্থা রাখছেন তাঁরা। তাঁর দাবি, জাতীয় মহিলা কমিশন ফোনে যোগাযোগ করলে কলকাতা পুলিশের উপরেই আস্থা রাখার কথা বলেছেন তাঁরা।
তবে এ দিন সংশ্লিষ্ট আইন কলেজে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে তাঁদের বাধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ জাতীয় মহিলা কমিশনের। তাদের দাবি, বেশ কিছু ক্ষণ বাগবিতণ্ডার পরে কমিশনের সদস্যদের পুলিশের সঙ্গে কলেজের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়। পুলিশ তাঁদের স্পষ্ট জানায়, সিল করা ঘর খোলা সম্ভব নয়। ঘটনাস্থলের ছবি ও ভিডিয়ো তুলতে দেওয়া যাবে না। কমিশনের সদস্য অর্চনা মজুমদার বলেন, “পুলিশ অভিযোগকারিণীর সঙ্গে আমাদের দেখা করতে দেয়নি। পুলিশ নাকি জানেই না যে, তিনি কোথায়! এমন গুরুতর ঘটনায় নির্যাতিতা কোথায় পুলিশ জানে না? তা হলে এটা তাদের গাফিলতি। আর যদি জানে, তা হলে না বলাটা অবশ্যই তথ্য চাপার চেষ্টা।”
তবে লালবাজার জানায়, স্বচ্ছতার সঙ্গে দ্রুত তদন্ত শেষ করতে নতুন করে এক জন মহিলা সাব-ইনস্পেক্টর ও তিন জন সাব-ইনস্পেক্টরকে যুক্ত করা হয়েছে সিটে। আগেই এক জন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের নেতৃত্বে পাঁচ জনের দল গড়েছিল লালবাজার। সেই দলকে সাহায্য করবেন নবনিযুক্ত চার অফিসার। শনিবার প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে নির্যাতিতা পড়ুয়া আলিপুর আদালতে বিচারকের সামনে ঘটনার সব খুঁটিনাটিসুদ্ধ গোপন জবানবন্দি দিয়েছিলেন। রাতেই তরুণীর সাহায্যে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করা হয়। কলেজের ঘটনাস্থলের তিনটি সিসি ক্যামেরার সাড়ে সাত ঘণ্টার ফুটেজ নির্যাতিতার বয়ানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছে পুলিশ। এ দিন জোর দেওয়া হয় ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহে। সংশ্লিষ্ট চার জনের থেকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছে, দাবি পুলিশ সূত্রের।
তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে শনিবার রাতে মনোজিৎ মিশ্রের বাড়িতে প্রথমে যায় পুলিশ। মনোজিতের উপস্থিতিতেই ঘটনার সময়ে তার ব্যবহৃত শার্ট, প্যান্ট, জুতো, অন্তবার্সের মতো বিভিন্ন সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করা হয়। তিলজলার জাইব আহমেদের বাড়ি গিয়ে পোশাক ও নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তবে রবিবার প্রমিত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে হাওড়ার চ্যাটার্জিহাটের বাড়িতে পুলিশ গেলে মারমুখী জনতার মুখে পড়তে হয় অভিযুক্তকে। তার কঠিনতম শাস্তির দাবি জানান তাঁরা। পুলিশ কোনও রকমে অভিযুক্তকে নিয়ে তার বাড়িতে ঢোকে। বাড়ির দরজা খুলে দেন তার বাবা। তদন্তকারীরা জানান, বাড়িতে প্রমিতের কোনও বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম আছে কি না, খতিয়ে দেখতে তল্লাশি হয়। ঘণ্টা খানেক পরে দলটি বেরোয়। ধৃত তিন জনের মোবাইল পাঠানো হয়েছে ফরেন্সিক পরীক্ষায়। পরিষেবা দেওয়া সংস্থার কাছে ফোনের নথি চাওয়া হচ্ছে। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, ধৃত নিরাপত্তারক্ষী পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাকি তিন জনকে মুখোমুখি বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পরিকল্পনা রয়েছে।
ঘটনার সন্ধ্যা থেকে রাতের মধ্যে কত জন পড়ুয়া কলেজে ছিলেন, সেই তথ্য ও তাঁদের নামের তালিকা কলেজের কাছে চেয়েছে পুলিশ। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও কেউ যুক্ত কি না, তা-ও জানার চেষ্টা হচ্ছে। ওই দিন নির্যাতিতার সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, তা কলেজের কেউ কেউ জানত বলে পুলিশের একাংশের সন্দেহ। এ বিষয়ে কিছু প্রাথমিক সূত্রও মিলেছে বলে দাবি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)