Advertisement
E-Paper

রাজনীতি আর আনুগত্য পল্লবিত তৃণমূল আমলেও

এক হাতে তালি বাজে না। শাসকের চাহিদা নিয়ন্ত্রণ আর আনুগত্য। তারই জন্য মানের সঙ্গে আপস করেও পছন্দের ব্যক্তির হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়া। আর আনুগত্যের প্রমাণ দিতে সেই ব্যক্তি শাসকের হাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বশাসনের লাগাম সঁপে দিতে পিছপা নন।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৫ ০৩:১২
অবসন্ন উপাচার্য। শনিবার অবরোধ চলাকালীন। —নিজস্ব চিত্র।

অবসন্ন উপাচার্য। শনিবার অবরোধ চলাকালীন। —নিজস্ব চিত্র।

এক হাতে তালি বাজে না।

শাসকের চাহিদা নিয়ন্ত্রণ আর আনুগত্য। তারই জন্য মানের সঙ্গে আপস করেও পছন্দের ব্যক্তির হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়া। আর আনুগত্যের প্রমাণ দিতে সেই ব্যক্তি শাসকের হাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বশাসনের লাগাম সঁপে দিতে পিছপা নন। আর তাতেই হাতে হাতে তালি বাজছে।

রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে অশান্তির পরম্পরার এটা বড় কারণ বলে মনে করেন শিক্ষানুরাগী ও প্রবীণ শিক্ষকদের অনেকেই। এবং বাম আমলের এই ধারা তৃণমূল শাসনে আরও পল্লবিত হচ্ছে বলেও উদ্বেগ তাঁদের। প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর, কলকাতা— সর্বত্র একই রোগ।

১৯৬৬ সালের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আইনে কিন্তু উপাচার্য, সহ উপাচার্য, ডিন-রাই শেষ কথা। কলেজে অধ্যক্ষ। সরকার এ নিয়ে মাথা ঘামাতে যেত না। ১৯৭৭-এ রাজ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টায়। বামপন্থীরা তাঁদের কার্যত স্বৈরাচারী বলে দাগিয়ে

দিতে শুরু করেন। এরই পাল্টা হিসাবে শুরু হয় শিক্ষাক্ষেত্রে ‘গণতন্ত্রীকরণ’-এর প্রক্রিয়া। বামপন্থী এক প্রবীণ শিক্ষক নেতার কথায়, ‘‘এর সূত্রপাত সন্তোষ মিত্রের হাত ধরে। কলেজ শিক্ষক ছিলেন বটে, তবে দলে তাঁর প্রবল প্রভাব ছিল অবিভক্ত চব্বিশ পরগনার কৃষক আন্দোলনের নেতা হিসাবে। কার্যত তাঁর হাত ধরেই এল ১৯৭৯-এর নতুন আইন।’’ ওই আইনে গণতন্ত্রীকরণের নামে সংখ্যার দাপট শুরু হল। শিক্ষার সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট নন, এমন ব্যক্তিদেরও ভোটাধিকার দেওয়া হল বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কমিটি গড়ার জন্য।

শিক্ষানুরাগীদের অনেকেই মনে করেন, গণতন্ত্রের নামে এই কৌশলকে হাতিয়ার করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেওয়াকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান রাজ্য সিপিএমের অধুনা প্রয়াত সম্পাদক অনিল বিশ্বাস। শিক্ষামহলের অনেকেই যে প্রক্রিয়াকে ‘অনিলায়ন’ বলে কটাক্ষ করেন। এর ফল ভুগতে হয় উপাচার্য সন্তোষ ভট্টাচার্যকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই উপাচার্যকে প্রায় তার পূর্ণ মেয়াদটাই কার্যত বাড়িতে বসে অফিস চালাতে হয় দলীয় রাজনীতির দাপাদাপিতে। তবে ওই প্রতিকূলতার মধ্যেও সন্তোষবাবু মেরুদণ্ড সোজা রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনকে যথাসাধ্য আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এর থেকে শিক্ষা নিল আলিমুদ্দিন। উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে শুরু হল। প্রয়োজনে যোগ্যতা, দক্ষতার সঙ্গে আপস করা হোক, কিন্তু আনুগত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া দরকার সবার আগে।

আর এই পথ ধরে যাঁরা উপাচার্য পদে এলেন, তাঁদের অনেকেই প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারকে কার্যত বন্ধক রাখলেন রাজনৈতিক আনুগত্যের কাছে। সত্যেন সেনের মতো উপাচার্য ক্রমশই দুর্লভ হয়ে গেলেন, যিনি মন্ত্রী ডেকেছেন বলেই তাঁর দফতরে ছুটে যাবেন না।

ক্ষমতায় আসার অনেক আগেই এর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিল তৃণমূল। বিধানসভা নির্বাচনে তাদের ইস্তাহারেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক দখলমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বাম আমলের আইন সংশোধন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির লাগাম টানার একটা চেষ্টা শুরু হলেও তৃণমূলেরই প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রীদের একাংশের চাপে সেই প্রক্রিয়া চূড়ান্ত রূপ পেল না। বরং চাকা ঘুরে গেল উল্টো দিকে, পরিস্থিতি আবার আগের মতোই হয়ে গেল। এর জেরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজির হয়ে নিজেই উপাচার্যের ইস্তফার ঘোষণা করে দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় রাখঢাক না-করেই বলছেন, সরকার টাকা দেয়, তাই নিয়ন্ত্রণ করবে। এ কথা প্রতিবাদ করা তো দূর, শিক্ষামন্ত্রীর তলব পেয়ে তাঁর দফতরে গিয়ে হাজির হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। মুখ্যমন্ত্রীর লন্ডন সফরের সঙ্গী হন আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনি যদি সেখানকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শিক্ষা সংক্রান্ত চুক্তি করতে গিয়েও থাকেন, তা হলেও প্রশ্ন ওঠে, এর জন্য মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গী হওয়ার কি জরুরি ছিল? তবে এ সবই ছাপিয়ে যায় যখন যোগ্যতার বিচার না-করেই শুধুমাত্র আনুগত্যের নিরিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদে আসীন হন এক সরকারি আমলার আত্মীয়!

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরেজি বিভাগের এমেরিটাস অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরীর মতে, বাম আমলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক প্রভাব ছিল সাড়ে ষোল আনা। কিন্তু বাম এবং তৃণমূল জমানায় এর পদ্ধতিগত ফারাক রয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘বাম আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারের কাঠামোটাকে কাগজে-কলমে বজায় রাখা হতো। ভিতরে ভিতরে নিজেদের লোক ঢুকিয়ে নিজেদের পছন্দমতো কাজ করিয়ে নেওয়া হত।’’ তৃণমূল আমলে তফাতটা কোথায়? সুকান্তবাবুর কথায়, ‘‘এখন তো স্বাধিকারের কাঠামোটাই ভেঙে ফেলে সরাসরি সরকারি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হচ্ছে।’’ প্রবীণ ওই শিক্ষক মনে করেন, শিক্ষামন্ত্রীর ‘বেতন দেন বলে নিয়ন্ত্রণ থাকবে’— এই ধরনের মন্তব্য এরই বহিঃপ্রকাশ। আবার সরকারি অনুদানের টাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর নিজে এসে মঞ্চে উঠে চেক দেওয়ার মধ্যেও এরই প্রতিফলন। অথচ এটি নিতান্তই একটি প্রশাসনিক কাজ, যা সবার অলক্ষেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই হওয়ার কথা।

সব সময় শাসক দলের সুরে সুর মিলিয়ে চলার ব্যাপারে উপাচার্যদের কারও কারও প্রবণতায় আখেরে প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিই হচ্ছে বলে মনে করেন যাদবপুরের প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসু। তাঁর দাবি, ‘‘এক দিনের জন্যও রাইটার্সে যাইনি। শিক্ষামন্ত্রী নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন কথা বলতে।’’

রাজ্যের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতির প্রভাব যে ভাবে পড়েছে, তাতে একটা অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন আইআইএম কলকাতার শিক্ষক অর্থনীতির অনুপ সিংহ। এতে ছাত্রছাত্রী, অভিভাবকদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে তিনি মনে করেন। প্রেসিডেন্সির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের মনে হয়েছে, বর্তমান উপাচার্য শাসক দলের কাছের লোক। কার্যত যিনি মেন্টর গ্রুপের প্রধান, সেই সুগত বসু তো এখন তৃণমূলের সাংসদ। ফলে রাজনীতির সংস্রব নিয়ে তো আর কিছু আড়াল করার নেই।’’ অনুপবাবুর আক্ষেপ, ‘‘এর পরেও যখন দেখি, একের পর এক উঁচু দরের শিক্ষক প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তখন বুঝতে হবে ওখানে শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে সত্যিই চিন্তার কারণ রয়েছে। বাম আমলে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের যে ধারা ছিল, তারই ধারাবাহিকতা চলেছে বলে মত অর্থনীতির ওই শিক্ষকের।

শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ সব অভিযোগ মানতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার বলতে শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে স্বাধীনতা বোঝায়। প্রশাসনিক ও আর্থিক ব্যাপারে অনেকটাই সরকারের এক্তিয়ার।’’ শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘সরকারের তো একটা শিক্ষানীতি থাকে। সেই শিক্ষানীতির প্রতিফলন তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই হতে হবে!’’ তাঁর দাবি, বাম আমলে যে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ধারা ছিল, তাতে ছেদ পড়েছে তৃণমূল শাসনে। এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা— দুটোই রয়েছে।

তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব প্রেসিডেন্সির এই ছাত্র অসন্তোষের মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তোষ ভট্টাচার্যের উপাচার্য থাকার সময়ের ‘কালো দিন’-এর ছায়া দেখছেন। এবং তাঁদের প্রতিক্রিয়া, ‘‘কিছুতেই ওই কালো দিন ফেরাতে দেওয়া হবে না। এই ধরনের অরাজকতা ঠেকাতে শেষ বিন্দু পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে।’’

কিন্তু এই জমানাতেই তো আরাবুল ইসলামের মতো নেতারা কলেজ পরিচালন সমিতির মাথায়। তাই মন্ত্রীর বয়ান বা তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের এই আশ্বাসের সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন থাকেই!

anuradha lohia presidency university tmc regime politics loyalty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy