গোটা কলকাতাই যেন কাশি নগরী!
গত ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে সময় যত এগোচ্ছে, ক্রমেই বাড়ছে কাশির প্রকোপ। কেউ ভুগছেন টানা ১০-১৫ দিন, কারও আবার তিন-চার সপ্তাহের আগে কাশি কমছে না। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, প্রতি বছরই আবহাওয়ার পরিবর্তনের সময়ে ভাইরাসের দাপাদাপিতে এমন সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু এ বারে সেই সমস্যা অনেকটাই বেশি। শিশু থেকে প্রবীণ— কাশি থেকে যেন রেহাই নেই কারও। তবে, ছোটদের ক্ষেত্রে সমস্যাটি মারাত্মক আকার ধারণ করে প্রাণসংশয় তৈরি করছে। আর মাঝবয়সি ও প্রবীণদের ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী কাশিতে প্রাণান্তকর অবস্থা তৈরি হচ্ছে।
চিকিৎসকদের মতে, ভাইরাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দূষণও। যার জেরে সমস্যা আরও জটিল আকার নিচ্ছে। শহরের প্রায় প্রতিটি হাসপাতালের বহির্বিভাগ এবং চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে আসা রোগীদের মধ্যে ৭০ শতাংশেরই একই সমস্যা— কাশি। সংক্রামক রোগের চিকিৎসক যোগীরাজ রায়ের কথায়, “ভাইরাসের সংক্রমণে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত কাশি থাকতে পারে। একের পর এক ভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছেন এক-এক জন। ফলে, একটা সমস্যা সারতে না সারতেই আর একটিতে আক্রান্ত হচ্ছেন।” বক্ষরোগের চিকিৎসক ধীমান গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, “সংক্রমণ-পরবর্তী কাশি বা কফ সাধারণত তিন-চার সপ্তাহ পরে কমে যায়। কিন্তু এ বারে এক মাসও থাকছে। কাশির তীব্রতাও বেশি। মনে হচ্ছে, অ্যাডিনোর রিকম্বিন্যান্ট ভাইরাসই এর জন্য বেশি মাত্রায় দায়ী।”
কেন এমন অবস্থা, তার ব্যাখ্যায় ভাইরোলজিস্ট সিদ্ধার্থ জোয়ারদার জানাচ্ছেন, আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তনে তাপমাত্রা ওঠানামা করলে শরীরকে তার সঙ্গে কোষীয় স্তরে মানিয়ে নিতে হয়। যার জেরে কোষের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয় এবং প্রতিরোধী কোষেও (ইমিউন সেল) তার প্রভাব পড়ে। এর ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যান্টিবডি, সাইটোকাইন, পারফোরিনের মতো প্রোটিন জৈব অণু (বায়ো মলিকিউল) তৈরি করতে পারে না প্রতিরোধী কোষগুলি। সিদ্ধার্থ বলেন, “শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতার দুর্বলতার সুযোগে জীবাণু ও ভাইরাসের বাড়বাড়ন্ত হয়। দূষণ ও প্রতিকূল আবহাওয়ার জোড়া ফলায় তাই ঘরে ঘরে জ্বর, কাশির প্রকোপ।”
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শুকনো কাশির প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। তবে, কিছু ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণে কাশির সঙ্গে কফও থাকছে। শুকনো কাশির ক্ষেত্রে জ্বর কিংবা গায়ে ম্যাজম্যাজে ভাব দিয়ে সমস্যা শুরু হচ্ছে। টানা কয়েক সপ্তাহ সেই অস্বস্তিকর সমস্যার প্রথম দিকে গলা বসে থাকছে। সঙ্গে শুরু হচ্ছে প্রবল কাশি। এর পরেও বেশ কিছু দিন খুশখুশে কাশির মারাত্মক প্রকোপ থাকছে। জনস্বাস্থ্যের চিকিৎসক অনির্বাণ দলুইয়ের কথায়, “অ্যাডিনোভাইরাসের পাশাপাশি আরএসভি, ইনফ্লুয়েঞ্জা-সহ পুরনো করোনাভাইরাসেও ছোট-বড় অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন। সেই ভাইরাস নাক, মুখ, শ্বাসনালি দিয়ে গিয়ে ফুসফুসেও হানা দিচ্ছে।” চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, মুখ ও নাকের গহ্বর, গলা (ফ্যারিংস), ব্রঙ্কাস এবং ব্রঙ্কিয়োলসের আগে পর্যন্ত অংশ হল ‘আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট’। এর নীচের অংশ ফুসফুস, অর্থাৎ, তার মধ্যে যে ছোট ছোট ব্রঙ্কিয়োলস বা অ্যালভিয়োলাই রয়েছে, সেটি হল ‘লোয়ার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট’।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট সংক্রমণে শ্বাসতন্ত্রে প্রদাহ হচ্ছে। ক্রমাগত সেখান থেকে মিউকাস নিঃসরণ হচ্ছে। ফলে, কাশির প্রকোপ তৈরি করছে। কিছু কিছু ভাইরাস ফ্যারিংসের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ভেদ করে অনেক দিন পর্যন্ত থেকে যাচ্ছে। আবার, উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়ায় ভাইরাস বার বার সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। এরই সঙ্গে তাপমাত্রার খামখেয়ালিপনায় শরীরে স্থানীয় স্তরের প্রতিরোধ ক্ষমতা (লোকাল ইমিউনিটি) কমতে শুরু করে। দূষণের কারণে সমস্যা আরও বাড়ছে। সংক্রামক রোগের চিকিৎসক ও ভাইরোলজিস্টদের মতে, প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমলে শ্বাসনালির উপরের অংশে বসবাসকারী আপত নিরীহ জীবাণুরাও বংশবিস্তার করে, দাদাগিরি শুরু করে। আর তাতেই সমস্যা আরও বাড়ছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)