বিষ: এ ভাবেই নিত্য দূষিত হচ্ছে শহর। নিজস্ব চিত্র
এ এক আজব শহর!
শহরের বাতাসকে বিষমুক্ত করতে প্যারিসের মেয়র সেখানে ডিজেল গাড়ির চলাচল নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। ইউরোপের দেশগুলি ডিজেল গাড়ির ব্যবহার দিনকে দিন কমিয়ে দিচ্ছে। এমনকী ঢাকা, নয়াদিল্লি বাতাস দূষণমুক্ত রাখতে ডিজেলচালিত বাণিজ্যিক যানবাহন রাস্তা থেকে তুলে দিয়েছে। মুম্বই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু ডিজেলের পরিবর্তে ঝুঁকতে শুরু করেছে সিএনজি-চালিত যানবাহনের দিকে। ব্যতিক্রম কলকাতা!
পরিবেশকর্মীদের দেওয়া তথ্য বলছে, কলকাতা শহরে যে সব বাণিজ্যিক যানবাহন (বাস, ট্যাক্সি, লরি) চলে, তাদের শতকরা ৯৯ ভাগ ডিজেলচালিত। এক পরিবেশকর্মীর মন্তব্য, দিনকে দিন শহরের বাতাস ভারী এবং বিষাক্ত হয়ে ওঠার মূলে যে ডিজেলচালিত গাড়ি, তা নিয়ে কোনও মতপার্থক্য নেই। এক পরিবেশকর্মী বলেন, ‘‘ডিজেলচালিত যানবাহন নিয়ন্ত্রণে রাজ্য সরকারের কোনও হেলদোল নেই। বুধবারও নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে প্রায় দেড়শো ডিজেলচালিত বাস রাস্তায় নামিয়েছে রাজ্য সরকার।’’
বস্তুত, মহানগরের বায়ুদূষণ নিয়ে সরকারের মনোভাব মালুম হয় জাতীয় পরিবেশ আদালতের মামলাগুলিতে। শহরে পরিবেশবান্ধব সিএনজি জ্বালানি চালু নিয়ে মামলায় সরকারের তরফে নানা টালবাহানা চলেছে। বায়ুদূষণের মামলায় ১৬ মাসেও হলফনামা জমা দিতে পারেনি পরিবেশ দফতর ও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। এক পরিবেশকর্মীর আক্ষেপ, ‘‘দূষণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পর্ষদের কোনও হুঁশ নেই। শুধু পরিকল্পনার কথাই শুনি।
দিল্লির ক্ষেত্রে পরিবেশ আদালত যতটা কঠোর, কলকাতার পূর্বাঞ্চলীয় বেঞ্চ থেকে তেমন কড়া নির্দেশ মিলছে না।’’
পরিবেশবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, ১৫ বছরের পুরনো যে সব বাণিজ্যিক গাড়ি কলকাতায় চলছে, সেগুলি সবই ডিজেলচালিত। গাড়ির ইঞ্জিন যত পুরনো হবে, তার থেকে তত বেশি ধোঁয়া বেরোবে এবং সেই ধোঁয়ায় বিষ কণার পরিমাণ থাকবে তত বেশি। এমনকী, সরকারি, বেসরকারি বাস, পুলিশের ভ্যান, পুরসভার আবর্জনার গাড়ি, শহরের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করা লরিগুলির নিয়মিত দূষণ পরীক্ষা হয় না বলেই অভিযোগ পরিবেশকর্মীদের। শুধু পুরনো বাণিজ্যিক গাড়িকেই দোযারোপ করছেন না পরিবেশবিজ্ঞানীরা। তাঁরা দায় চাপাচ্ছেন, যে কোনও ডিজেল গাড়ির উপরেই।
মহানগরে ডিজেল গাড়ি কমানোর দাবি উঠছে কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশের অন্দর থেকেও। কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আমাদের যে সব কর্মী-অফিসারকে দিনের পর দিন গাড়ির ধোঁয়া গিলতে হয়, তাঁদের সুস্থ রাখার জন্যই কলকাতায় কমিয়ে দেওয়া উচিত ডিজেলচালিত গাড়ি।’’
কেন ডিজেল পুড়লে বাতাসে বাড়ে বিষ? শারীরবিজ্ঞানীরা বলছেন, ডিজেল থেকে নির্গত ক্ষতিকারক কণার পরিমাণ পেট্রোল গাড়ির থেকে অনেক বেশি। সেই সব কণার মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের বেঞ্জিন যৌগ, কার্বন কণা যা শুধু ফুসফুসেরই ক্ষতি করে না, বিভিন্ন কোষের মধ্যে গিয়ে ক্যানসারের কারণ হতে পারে।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, গত ছয় বছরে কলকাতার বাতাসে ক্ষতিকারক সেই কণার পরিমাণ শতকরা ৬১ ভাগ বেড়েছে। নাইট্রোজেন ডাই অক্সাই়ডের পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। আর এ জন্য পরিবেশকর্মীরা ডিজেলকেই মূলত দায়ী করছেন। যাঁদের ফুসফুসের রোগ রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড সেই রোগকে আরও ত্বরান্বিত করে বলেও জানাচ্ছেন শারীরবিজ্ঞানীরা।
পুরসভা কিংবা রাজ্য সরকার এই বিষবায়ুর হাত থেকে নাগরিকদের বাঁচাতে কী করছে, উঠেছে সেই প্রশ্ন। কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা নতুন বাসও কেন ডিজেলচালিত হবে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন পরিবেশবিদেরা। রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা সরাসরি এই প্রশ্নের জবাব দেননি। পরিবহণ দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘বিষয়টি নিয়ে আমরা সচেতন। কী ভাবে বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো যায় তা নিয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করছে।’’
ঢাকা, দিল্লি পারলেও কলকাতা কেন পিছিয়ে?
কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কলকাতাতেও গ্যাস ও বিদ্যুৎচালিত যান ব্যবহার নিয়ে পদক্ষেপ করা হচ্ছে। খুব শীঘ্রই যাতে তা চালু করা যায়, তার চেষ্টা হচ্ছে।’’ ‘‘তবে কলকাতার মতো জনবহুল শহরে এই প্রকল্প কার্যকর করতে কিছু সময় তো লাগবেই,’’ মন্তব্য মেয়রের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy