পুলিশ জানাচ্ছে, সারা বছর শহরে কড়া নজরদারি থাকে। অথচ, ঘটে চলেছে একের পর একগুলি চলার ঘটনা। তা হলে কি পুলিশি নজরদারি আসলে ‘বজ্র আঁটুনি, ফস্কা গেরো’?
সোমবার হরিদেবপুরে এক মহিলাকে গুলি করার ঘটনা সামনে আসার পরে নতুন করে এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এত গুলি, বোমা কলকাতায় আসছে কোথা থেকে? কারাই বা নিয়ে আসছে? পুলিশই বা কী করছে?কলকাতা ফের দেশের মধ্যে নিরাপদতম শহরের তকমা পেয়েছে কিছু সপ্তাহ আগেই। নিরাপদতম শহরের চিত্রের সঙ্গে যখন-তখন গুলি চলার, বোমা পড়ার মতো এলাকার চেহারা মেলে কি? প্রশ্ন তুলছেন শহরবাসী।
হরিদেবপুরের ঘটনায় পুলিশ বাপ্পা দাঁ নামে আরও এক জনকে মঙ্গলবার গ্রেফতার করেছে। সোমবারই বাবলু ঘোষ নামে এক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এই নিয়ে এ ঘটনায় গ্রেফতার হল দু’জন। উদ্ধার হয়েছে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রটিও। কিন্তু কোথা থেকে সেটি আনা হয়েছিল, কে নিয়ে এসেছিল— সে সব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি পুলিশের কাছ থেকে। তবে সারা বছরই নানা সময়ে এমন আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের কথা জানায় পুলিশ। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘোরার জন্য বা বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়ার খবরও জানানো হয়। কিন্তু কোন পথে এই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র শহরে ঢুকছে, সে সম্পর্কে কখনওই স্পষ্ট তথ্য প্রকাশ করা হয় না বলে অভিযোগ। অথচ, শহরে একের পর এক শুটআউটের ঘটনা ঘটতে থাকে।
২০২৩ সালের ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’-র (এনসিআরবি) রিপোর্টে টানা চতুর্থ বার নিরাপদতম শহরের তকমা পেয়েছে কলকাতা। কিন্তু ২০২৪ সাল থেকেই কলকাতায় একের পর এক গুলি চলার, বোমা পড়ার ঘটনা আরও বেশি করে সামনে আসতে শুরু করেছে। তাতে অনেকেরই প্রশ্ন, এই মুড়িমুড়কির মতো গুলি-বোমার ঘটনা নিরাপদতম তকমা কি আর ধরে রাখতে দেবে?
কসবায় তৃণমূলের পুরপ্রতিনিধি সুশান্ত ঘোষকে বাড়ির সামনে গুলি করার চেষ্টা দিয়ে শুরু। এর পরে পুজোর আগে আনন্দপুরের গুলশন কলোনিতে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তাণ্ডব চালাতে দেখা যায় দুষ্কৃতীদের। অভিযোগ, পুলিশি প্রহরার মধ্যে বোমাবাজিও চলে রাত পর্যন্ত। মহালয়ার সকালে আবার চারু মার্কেট থানা এলাকার দেশপ্রাণ শাসমল রোডে একটি জিমে ঢুকে মালিককে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটে। কিন্তু জিমের সিসি ক্যামেরা অকেজো থাকায় পুলিশ তদন্তে ধাক্কা খায়। কারা, কেন ওই হামলা চালিয়েছিল, পুলিশের তরফে স্পষ্ট করে কিছুই জানানো হয়নি এখনও। একই ভাবে, মহালয়ার পরের দিনই গার্ডেনরিচে গুলি চলার ঘটনা নিয়েও মুখে কুলুপ এঁটেছে পুলিশ। কালীপুজোর দিনই আবার বিধাননগরের প্রাক্তন তৃণমূল পুরপ্রতিনিধি নির্মলদত্তকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর চেষ্টার ঘটনা ঘটে ই এম বাইপাস লাগোয়া দত্তাবাদের কাছে। ২৭ অক্টোবর পুজো মিটতে যাদবপুরের বিজয়গড়ে এক মহিলাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। এর পরেই ঘটেছে সোমবারের হরিদেবপুরের ঘটনা। এতেই প্রশ্ন উঠছে, শহরে এত আগ্নেয়াস্ত্র আসছে কোথা থেকে?
পুলিশের তরফে স্পষ্ট উত্তর মেলেনি। বাহিনীর অন্দরেও এক-এক জন এক-এক রকম দাবি করছেন। একাংশ বলছেন, বিহারের মুঙ্গেরে তৈরি হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র ঝাড়খণ্ড হয়েচোরাপথে শহরে আসছে। বেশ কয়েক বার হাতবদলের পরে শহরে এসে পৌঁছচ্ছে এই অস্ত্রের সম্ভার। অস্ত্রের কারবারিরা এই চোরাচালানের কাজে মূলত সড়কপথ ব্যবহার করছে।
বিহার থেকে মালদহ, মুর্শিদাবাদ হয়েও শহরে আগ্নেয়াস্ত্রপ্রবেশ করে বলে পুলিশের অন্য একটি অংশের বক্তব্য। আর একটি অংশের আবার ধারণা, এ রাজ্যে অস্ত্র আসছে বিহারের মুঙ্গের থেকে দুমকা হয়ে সড়কপথে। কখনও আবার খানিকটা ঘুরপথে ধানবাদ, আসানসোল হয়েও চলে রাইফেল, পিস্তল, ওয়ান শটার ও ‘কাট্টা বন্দুক’-এর চোরাচালান।
কিন্তু পথের হদিস জানলেও আগ্নেয়াস্ত্র শহরে ঢোকা পুলিশ বন্ধ করতে পারে না কেন? কেন রোখা যায় না গুলি চলার পরের পর ঘটনা? এক পুলিশকর্তার মন্তব্য, ‘‘ভোটের মুখে এমনিতেই অস্ত্রের বাড়বাড়ন্ত হয়। তখনই এই সব বাড়ে। ভোট মিটতে সে সব অস্ত্র বিক্রি করে দেওয়া হয়।’’
তা হলে কি আগামী বছরের বিধানসভা ভোটের আগেও বাড়বে আগ্নেয়াস্ত্রের আস্ফালন? লালবাজারের কোনও কর্তাই এ নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চাননি। যুগ্ম-নগরপাল পদমর্যাদার এক পুলিশকর্তা শুধু বলেন, ‘‘কড়া তল্লাশি এখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে।’’
কিন্তু তাতে বিপদ কাটছে কি? আশঙ্কা থেকেই যায়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)